তুমি বাপু মেয়ামানুষের কথার মধ্যে আসসা কিসক? ছছাটোবিবির এক ধমকেই শরাফত সবটা মনোযোগ নিয়োগ করে আসরের নামাজের অজু করায়। মাস কয়েক আগে বড়োবিবি মরার পর ছোটোবিবির তিড়িংবিড়িং লাফানো বন্ধ হয়েছে, তার তেজ এখন সংহত। দুই বিবির ঠাণ্ডা ও গরম লড়াই থেকে রেহাই পাবার স্বস্তিতে শরাফত এখন ছোটোবিবির এসব বকাঝকা অকাতরে হজম করে, বরং বহুকাল বাদে এক স্ত্রী সংসারের সুখ সে ভোগ করে তারিয়ে তারিয়ে।
শরাফত ঘরের ভেতরে আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর জোরে জোরে বলে নামাজ শুরু করলে ছোটোবিবি প্রাণ খুলে কুলসুমের হত্যাকাণ্ড, কেরামতের সঙ্গে তার সম্পর্ক, পাকুড়তলা থেকে পাকুড়গাছের উধাও হওয়া, চোরাবালির ভৈতরে শুয়ে কুলসুমের কেলেঙ্কারিতে ক্ষুব্ধ তমিজের বাপের দাপাদাপি, সন্ধ্যা হলেই সেখানে আগুন জ্বলে ওঠা এবং এসবের ফলে তাদের ইটখোলা উঠে যাওয়া প্রভৃতি বিষয়ে নানাকরম প্রশ্ন করে এবং প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাব দেয় সে নিজেই। ফুলজান উঠে দাঁড়ালে তার হাতে সের তিনেক চিড়ার একটা পুটলি দেয়, তোক দিয়া চিড়া কোটালাম। তোর চিড়া খুব ভালো হছিলো রে। তোর বেটিক খিলাস। বলতে বলতে তার বাৎসল্য উথলে ওঠে, তমিজের নামে মিলাদ পড়াস রে। যা শুনি, ওদিককার খবর ভালো লয়।
নতুন ধান উঠলে গত পৌষে চিড়া কোটার জন্যে মণখানেক পানিশাল ধান পাঠিয়ে দিয়েছিলো ছোটোবিবি। টাকাও দিয়েছিলো আগাম। মণ্ডলের টেকি তো সব ব্যস্ত থাকে। চাল কোটায়। আর এখানে ধান ভানে সব মাঝিপাড়ার বৌঝিরা, চিড়া কোটার তারা জানে কী? চেঁকির পিছাড়িতে তাদের এলোমেলো পায়ের চাপে কেঁকির মুগুরটা গড়ের মধ্যে পড়ে ধাপ দুপ করে, ধানটা ভাজাও তাদের ঠিক হয় না। তাদের চিড়া হয় ফেটে যায়, না হয় চিটকা চিটকা হয়। মণ্ডল বাড়ির চিড়া তাই কোটা হয় সব হুরমতুল্লার বাড়িতে। তা ফুলজান নিজেই সের চারেক চিড়া সরিয়ে রেখেছিলো, ছোটোবিবি তো আর মেপে দেখে নি। বেটির জন্যে রাখা চিড়া খাইয়ে দিলো বাপকে। বাকিটা রেখে দিয়েছে তার মাচার নিচে হাঁড়ির ভেতর; গোখরা সাপ বেরুবার পর তার বাপ সেই মাচায় আর শোয় না, সেখানে থাকে এখন ফুলজান। একদিক থেকে ভালোই। ওর তলায় হাত দেওয়ার সাহস কারো নাই। এখন এই পুটলিটা যে কত্তো দিন ওখানে লুকিয়ে রাখতে হয় কে জানে? এই সের তিনেক চিড়া তমিজের চার বেলার নাশতা। আর খেতলালের গুড় হলে তিন বেলাতেই সাপটে দেবে। মাঝির বেটা মানুষটা এতোও খেতে পারে গো!—তমিজের নামে। এরা মিলাদ পড়াতে বলে কেন?-এই মানুষ পুলিসের গুলিতে মরবে? অতোই সোজা? মণ্ডলবাড়ির সব মানুষ চাইলেই, কালাম মাঝি চাইলে, আমতলির দারোগা চাইলেই কি আর তমিজ মরে?-ফুলজানের গালে ঘ্যাগে গলায় বুকে তমিজের গরম নিশ্বাস এসে লাগে কতোদূর থেকে। একেকবার মনে হয়, কতো বা বচ্ছর পার হলো! আবার কখনো চমকে ওঠে, সারা গা তার গনগন করে তমিজের নিশ্বাসের শিখায়। শিখাতেই হয়তো ফুলজান চমকে উঠে তাকায় একটু দূরে। হুরমতুল্লা সেখানে বসে বসে ঝিমাচ্ছে।
মগরেবের ওকতো গেলো। বস্যা টোপ পাড়া?
ফুলজানের শুকনা গলা শুনে আকাশের দিকে মুখ তুলে হুরমতুল্লা ফের সচল হয়ে ওঠে। আজ বুঝি পূর্ণিমা। তামাম ধানখেতের ওপর যেন চালের পিটুলি দিয়ে লেপে দেওয়া হয়েছে। আর চাঁদ থেকে দুধ পড়ছে, তাই সারাটা ধানখেত জুড়ে দুধের হালকা সুবাস। ফুলজানের বেটিটা এতোক্ষণ না খেয়ে আছে। দুধের গন্ধে তার নিশ্চয় খিদে পাচ্ছে। দুধ দিতে না পারুক, কাউনের চালের ভাত তো দুটি মুখে দিক। নিড়ানি দিতে দিতেই সে বলে, ঘরত যা। তোর বিটির খিদা নাগিছে না?
বুড়ার খেয়াল শুধু তার বেটির খিদার দিকে, কার্তিক মাসে দুটো কাউনের চালের ভাতই তো খায়, বুড়ার তাও সহ্য হয় না। বাপকে ভালোমতোন একটা খোঁচা দিতে তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না, জবাব দেয়, কাম থুয়া উঠি ক্যাংকা করা? বেন থ্যাকা তো মেলা মানুষ যায় এবিন দিয়া। কাম আগায়া থুই। কাম তো হামার করাই লাগবি।
তার মেয়ের খিদের কথা বলে হুরমতুল্লা আসলে খোঁচা দিয়ে ফেলেছে ফুলজানের পেটেই। ফুলজানের নিজেরই বেজায় খিদে পেয়েছে বলতে গেলে দুপুরে ভাত খাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই। কাউনের চালের খসখসে ভাত হজম হয়ে পেট তার সেঁধিয়ে গেছে পিঠ বরাবর। বাড়ি ঢুকে খেতে তো হবে সেই কাউনের ভাতই, তাও এই বেলার খোরাকি আধপেটার বেশি নয়। খেসারির ডাল থাকলে ভাতটা নরম হয়, ঘরে খেসারি। পর্যন্ত নাই। খেসারির ডাল ছাড়াই খসখসে কাউনের ভাতের ভাবনাতেও তার খিদে এতোটুকু কমে না। তখন সবটা মন দিতে হয় নিড়ানির দিকে। কিন্তু বেটির জুলুমে কামের দিকে মন দেওয়ার জো আছে তার? মেয়েটা তার কথা কয় কম, এই বয়সের ছেলেমেয়েদের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু স্বভাবটা বড়ো ছটফটে। কোথাও এক মুহূর্ত বসে থাকতে পারে না, সবসময় এদিক ওদিক করছেই। এই তো কিছুক্ষণ আগে বেশ খেলছিলো মায়ের পাশে বসে। আবার এখন মায়ের কাধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ও মা, খিদা নাগিছে, ভাত খামো।কথাটা একবার বলেই মায়ের মাথায় হাতের চাপ দিয়ে তাগাদা দিতে লাগলো। তবে এখন ওকে ভাত দেওয়া চলবে না। এখন খেলে রাত না। পোহাতেই বিছানায় শুয়েই বেটি ঠেলতে শুরু করবে ফুলজানকে। একবার মাত্র মা ভাত খামো বলে সে অবিরাম ঠেলা দিতেই থাকলে ফুলজান কিছুতেই কথা না বললে কিংবা তার ঘুম না ভাঙলে মাচা থেকে উঠে বেটি তার ঢুকে পড়ে মাচার নিচে। তমিজকে খুঁজতে পুলিস এলে ওখানে গোখরা বেরিয়েছিলো। মাটির নিচে নাকি আরো সাপ থাকতে পারে। ফুলজানের ভয় করে। না, এখন বেটিকে কিছুতেই ভাত দেওয়া চলবে না।