দিঘির পুবে পাঁচুন হাতে নিড়াতে নিড়াতে ফুলজান হুরমতুল্লাকে প্রায় সেজদা দেওয়ার মতো উপুড় হওয়া দেখে আঁচ করে, আবছা আলোয় বাপের চোখে সবই। ঝাপসা ঠেকছে। বুড়া এখন ধানগাছ উপড়ে না ফেলে। কিন্তু বাপের সঙ্গে কথা বলতে মন চায় না তার। নবিতনের জন্যে তার সোয়াগ উথলাতে দেখে ফুলজানের একেকবার ইচ্ছা করে, বাড়িতে আগুন দিয়ে, জমির গোছা গোছা ধানগাছ সব উপড়ে ফেলে বেটিকে কোলে নিয়ে সে বেরিয়ে যায় যেদিকে দুই চোখ চায়। দোকানদার জামাইকে টাকা দেওয়ার জন্যে বুড়ার গোয়া চুলকায়। আর বড়ো জামাইটা যে তার কতোদিন থেকে ঘরছাড়া, কৈ, বুড়া তো তার তত্ত্বতালাস কিছুই করে না। পালপাড়ার কেষ্ট পাল। একদিন এদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছিলো, হুরমতুল্লার দুয়ারে হাঁক দিয়ে জানিয়ে গেলো, কোথায়, ঠাকুরগাঁও না নাচোল না কোথায় চাষারা উৎপাত করেছিলো জোতদারদের সঙ্গে, পুলিস গিয়ে মেলা মানুষকে গুলি করে সাফ করে দিয়েছে, জেলের মধ্যেও কিছু ভরেছে। তো তাদের মধ্যে নাকি এই এলাকার চাষাও আছে। কেষ্ট পাল এর বেশি কিছু বলতে পারে না। ফুলজান তাই বাপকে একটু যেতে বললো মণ্ডলবাড়িতে। বাপজান, ওই বাড়িত গেলে ব্যামাক খবরই পাওয়া যাবি। ফুলজান বুড়াকে এমন কি তার বেটির জন্যে সরিয়ে রাখা চিড়া খাইয়ে দিলো এক পেট। বুড়া গেলোই না। তা গেলেই বা কী হতো? মণ্ডলবাড়ির পোষা গোলাম সে, গিয়ে মণ্ডলের হাগা গোয়াখান জিভ দিয়ে সাফ করে আসতো। তমিজের কথা সেখানে ভোলার মতো মুরোদ কি এই বুড়ার হতো?
আবছা আলোয় আর আবছা আন্ধারে এখান থেকে হুরমতুল্লাকে দেখায় মোষের দিঘির দক্ষিণ পাড়ের শিমুলগাছ থেকে ছিটকে পড়া ব্যারামে বুড়া শকুনের মতো। দেখে ফুলজানের হাতও ভারি হয়ে আসে। তার হাতে পাঁচুন একটি আগাছায় শিকড়ে বারবার খোঁচায়, খোঁচানোর গতি বড়ো ধীর। মাটি ও আগাছার সঙ্গে ওই পাঁচুনের ঘষাঘষিতে শোনা যায় মণ্ডলবাড়ির কাদেরের কথা, উগলান খবর কি পুলিস সব কয়? কতো মানুষ মারে, জেলেত ভরে, উগলান হিসাব কি সব রাখা যায়?
তমিজের খবর নিতে হুরমতুল্লা শরাফতের বাড়িতে না গেলে ফুলজান কী আর করে, নিজেই একদিন চলে গিয়েছিলো গিরিরডাঙায় মণ্ডলবাড়ি। কোলে তার বেটি আর কাপড়ের কোঁচড়ে লুকানো নবিতনের সেলাই-করা কথা।-পালাপাড়ার কোন বৌ পুরনো কাপড় দিয়েছিলো, পরে আর নিতে আসে নি। মনে হয় ইনডিয়া চলে গেছে। আর যদি আসেও তো ফুলজান তাকে পাঠিয়ে দেবে নবিতনের শ্বশুরবাড়ি। দোকানদার ভাতার তার নতুন কাপড় কিনে দেবে, কথা না হয় নবিতন আরেকটা সেলাই করবে।
কাদেরের বৌ কাঁথা পেয়ে মহা খুশি। তাদের শিমুলতলার কাঁথার এতো নাম, চটের ওপর উলের কাজ করা তার দাদীর মসজিদ আর চাঁদ তারা আঁকা জায়নামাজ এতোই সুন্দর যে, দেখলেই তার ওপর দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এই চাষার মেয়ে নানা রঙের সুতায় এমন করে সব পাখি, মাছ, হাতপাখা আর ফুল বুনে রেখেছে যে, একবার দেখলে আর চোখ ফেরানো যায় না।
আবদুল কাদের কিন্ত অতো খুশি নয়। কেষ্ট পালের কথা শুনে সে বলে, চাষাদের উৎপাত বন্ধ করতে পুলিসকে একটু গা ঝাড়া তো দিতেই হয়। উত্তরে আর পশ্চিমে কিছু মানুষ তো মারতেই হয়েছে, কিন্তু তাদের সবার নাম ধাম কি আর জানানো সম্ভব? তা এই নিয়ে এতো হৈ চৈ করার কী আছে? এখানে পুলিস একটা পাদ দিলেও ইনডিয়ায়। মহা শোরগোল ওঠে। আমাদের শিশুরাষ্ট্রটিকে গলা টিপে মারার জন্যে ইনডিয়া কী না করছে! পালপাড়ায় তো আবার ইনডিয়ার কাগজ ছাড়া আর কিছু ঢোকে না। কেষ্ট পাল বুঝি এইসব কথা খুব রাষ্ট্র করে বেড়াচ্ছে?
না ভাইজান। কোনো শিশুকে গলা টিপে দম বন্ধ করে মারার সঙ্গে কেষ্ট পালকে জড়াবার সম্ভাবনায় ফুলজান ভয় পায়। খুনের দায় থেকে তাকে বাঁচাতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে ফুলজান, না ভাইজান, তাই খালি কয়া গেলো কোনটে বলে পুলিসের গুলিত মানুষ মরিছে। তার মধ্যে হামাগোরে এটিকার–
হবার পারে। আবদুল কাদের আরো গম্ভীর হয়, ছোঁড়াটা এমনি খুব কামের আছিলো, কতো সুবিধা করা দিছিলাম। কোটে যায় কী করলো, আল্লাই জানে। আবদুল কাদের এবার তাকে বিদায় দেওয়ার শোভন আয়োজন করে, বৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, কাঁথা পছন্দ হয়েছে।
কাদেরের বৌ ফুলজানের বেটির হাতে একটা কাঁচা টাকা ধরিয়ে দেয়। কাদের দশ টাকার একটা নোট তার দিকে এগিয়ে ধরে, আগে না তোক কিছু দিছিলাম। তমিজের টাকা। কী ভেবে পাঁচ টাকার একটি নোট ফের এগিয়ে দেয়, রাখ।
এতো টাকা পেয়ে ফুলজানের বুক কাঁপে। তমিজের খবর দিতে পারে না, কাদের তাকে এতো খাতির করে কেন?
ফুলজান ফিরেই আসছিলো। তাকে ইশারায় উঠানে ডেকে নেয় মণ্ডলের ছোটোবিবি। ফুলজানের বেটিকে একটা শবরিকলা দিলে টাকাটা পড়ে যায় তার মুঠ এ থেকে। ফুলজান সঙ্গে সঙ্গে সেটা তুলে আঁচলে বাঁধে। বারান্দা ঘেঁষে উঠানের এক পাশে মোড়ায় বসে ছোটোবিবি ফুলজানকে পিড়িতে বসার ইশারা করে। ক্যা রে ফুলজান, তোর শাউড়ির খুনের মামলার কী হলো রে? তোর আগের সোয়ামি ওই বাউদাটার সাথে তোর শাউড়ির বলে কী কী আছিলো? ছিক্কা ছিক্কো! তোর শ্বশুর বলে দলদলার মধ্যে খালি দাপায়। হামাগোরে ইটের ভাটাই রাখা গেলো না, ওই জায়গাত নাকি এখন খালি আগুন জ্বলে? মনে হয়, তমিজের বাপই ওটি ইগলান করে। তুই জানিস কিছু?
ফুলজানকে এতো প্রশ্নের জবাব দিতে হয় না। তার আগেই তোমার খালি বেদাত কথা। বারান্দায় জলচৌকিতে অজু করার বদনা হাতে নিয়ে বলে ওঠে শরাফত, কবরের মধ্যে আজাব হলে মরা মানুষ দাপাবি। এর মধ্যে আবার আগুন পাও কোটে? ইটের ভাটা তুল্যা দিছি কি ভূতের ভয়ে? উগলান কথা কও, তোমার নামাজ কবুল হবি?