মাঝির বেটা হলে কী হয়, তমিজ কিন্তু হুরমতুল্লার ভিটার পেছনের জমির স্বভাবটা ঠিকই ধরেছিলো; প্রথমবার সেখানে আউশের আবাদ মারা পড়লো বটে, কিন্তু পরের বছর ফুলজানের জেদেই ফের আউশ বোনা হলো। আর খন্দও হলো, আল্লা রে আল্লা, রোপা আমনের জমিতেও মানুষ এতো ধান দেখে না। কিন্তু সেখান থেকে আদ্দেক জমি তো হুরমতুল্লাহ রাখতে পারলো না, বেচে বিয়ে দিলো তার পেয়ারের বেটি নবিতনকে। বুড়ার কথা : সব দোষ ফুলজানের। মাঝির বেটাকে নিকা করায় ভালো বংশের কোনো মানুষ কি তার বাপের সঙ্গে সম্বন্ধ করতে চাইবে? তাও হুরমতুল্লার শালা বলে ভাগ্নীটাকে বেটার বৌ করে ঘরে তুললো; শর্ত ছিলো একটাই : সোনামুখী হাটে তার মনিহারি দোকানটা সাজিয়ে দিতে হবে। জমি বেচা টাকাতে দোকান বড়ো করা যায় না। শালা তার মানুষ ভালো বলেই শুধু ওই জমি বেচার টাকা নিয়েই বেটার বৌ ঘরে তুললো, এখন চাপ দিচ্ছে বাকি টাকার জন্যে।
দেখা যাক, এবারের বর্গা করা আমন থেকে কিছু শোধ করা যায় কি-না। আজকাল এমন কি অঘ্রানের রোদেও হুরমতুল্লা অল্পেই কাবু হয়ে পড়ে; তার ঘন ঘন পিপাসা পায়, বদনা বদনা পানি খেয়েও বার বার পেচ্ছাব করা ছাড়া আর কোনো ফল হয় না। তাই রোদ পড়লে শরীরে যতোক্ষণ কুলায় হুরমতুল্লা পড়ে থাকে জমিতেই। ফুলজান থাকে। কাছাকাছিই। পাঁচুন দিয়ে নিড়াবার ফাঁকে ফাঁকে একটু দম নিতে তাই হুরমতুল্লার বাধে বাধো ঠেকে। নিজের বেটি হলে কী হয়, নিড়ানির সময় বাপকে একটু জিরাতে দেখলেই ফুলজান ক্যাটক্যাট করে, মাঝির বেটা কয়া তাক হেলা করো, মাঝির বেটা তো একদণ্ড বস্যা থাকে নাই। তার হাত চলিছে বাতাসের আগে।।
মাঝির বেটার সাথে লিকা বস্যা জাত ধর্ম খালু, সেই সোয়াগের মরদ আজ কয়টা বছর হয়া গেলো একটা খবর লেয় না। চার আনা পয়সাও তো পাঠায় না। হুরমতুল্লার এই আক্ষেপে এক হাত তুফাতের ধানগাছে কাঁপন লাগে, তাতেই তেজ ফিরে পেয়ে সে আরো হাত তিনেক জায়গা নিড়াতে পারে।
তমিজের পাত্তা নাই, সে কি আজকের কথা গো? কেষ্ট পালের মুখে কী না কী শুনে। ফুলজান বাপকে কয়েকদিন খুব ধরলো, মণ্ডলবাড়ি গিয়ে সে তমিজের খবরটা ঠিকঠিক। জেনে আসুক। হুরমতুল্লা বুড়ে হয়েছে বলে তো আর পাগল হয়ে যায়নি; শরাফত মণ্ডলের সামনে মাঝির বেটার খবর নিতে গিয়ে মানুষটাকে খামাখা খেপিয়ে দেবে নাকি? ফুলজানের আবদার রাখতে কি সে মণ্ডলের যেটুকু জমি বর্গা করছে তাও হারাবে নাকি? তার সংসার আছে না? তার আরো বেটি আছে না? বুড়া বাপের শরীরের দিকে ফুলজান ভুলেও কি একবার তাকায়? তার খাওয়া পরা জিরানের কথা কি ভাবে? এই বাড়িতে তাকে দরদ যদি কেউ করে তো সে এক নবিতন। মেয়েটার বিয়ে দিলাম জষ্টি মাসে, ছয় মাসের ওপর হয়ে গেলো, বেটিটাকে একবার বাড়িতে আনতে পারলাম না। হুরমতুল্লা নিজের দুই বিঘা জমি বেচে শালার হাতে তুলে দিলো বেটিকে, মেয়ে তার সুখেই থাকবে। শালাও তো তার বোন বোনাই ভাগ্নীদের জন্যে অস্থির; পোড়াদহ মেলা। লাগার তিন চার দিন আগে বোনকে নাইওর নিতে গোরুর গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে প্রতি বছর। আর এখন? বেয়াই হওয়ার পর তার চেহারাই পাল্টে গেলো। জমি বেচার টাকা। তো নিলোই, তাতেও নাকি সোনামুখী হাটে তার বেটার দোকানের সাজগোছ সম্পূর্ণ হয় না। তা হুরমতুল্লার পয়সার অভাব? কেন? জমিটা বেচে দিলেই তো হয়। তার বেটা আছে নাকি? জমি কি সে রেখে দেবে ওই মাঝির বেটার ভোগের জন্যে? দোকান সাজাবার হাউস না মেটা পর্যন্ত জামাই তার শ্বশুরবাড়ি আসবে না, বৌকেও পাঠাবে না।
দোকানদার জামাই পেয়ে হুরমতুল্লা এখনো খুশিই। চাষাভুষা কামলাপাট নবিতনটার পছন্দ নয়। মেয়েটার ছিলো সেলাইয়ের সখ, চাষার ঘরের মেয়ের হাতের কাজ যে এত চিকন কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। শ্বশুর বাড়িতে সে কি সেলাইফেঁাড়াই। করার সুযোগ পায়? মেয়েটার মনটাও বড়ো কোমল গো। ফুলজানের মতো মাঠে মাঠে, জমিতে জমিতে ঘুরে সে একটা মদ্দামানুষ হয়ে ওঠে নি।—মেয়েমানুষ, তার মেয়েমানুষের মতো থাকাই ভালো, মেয়েমানুষ জমিতে কামলা খাটলে বুক পাষাণ হয়ে যায়।
আর নবিতন?—দুপুরে বাপ ঘরে ফিরলে সে তাকে আর জমিতে ফেরত পাঠাতে চায় নি, ক্যা বাজান, এই শরীল লিয়া তুমি এই গনগনা ওদের মধ্যে ফির গতর খাটাবার যাবা কিসক গো?—সেই মেয়েকে হুরমতুল্লা আজ একবার চোখের দেখাটাও দেখতে পারে না। একেকবার ইচ্ছা হয়, দুত্তোরি, ভিটার পেছনের জমিটা না হয় বেচেই দিই। কিন্তু ঘরে তার মদ্দা কিসিমের খাণ্ডারনি বেটি আছে না একটা? সেটা তার ঘরের শনি, বংশের ইজ্জত মারা ঘেগি মাগী। ঘ্যাগভরা তার খালি হিংসা আর হিংসা।
হুরমতুল্লা আড়চোখে তাকায় দিঘির পুবের দিকে। দিঘির ঢালে, নিচে এক মনে নিড়ানি দিয়ে চলেছে ফুলজান। ফুলজানের বেটি পায়ে পায়ে উঠে গেছে দিঘির ঢালে, কাঠালগাছের নিচে। এমনিতে গাছের আন্ধার, তার ওপর ঘুড়িটা হয়েছে কালো কুচকুচে। বাপ দাদার গায়ের পাকা রঙ। ছুঁড়ির বাড়ও বড়ো বেশি, কে বলবে এখনো তিন বছরে পড়ে নি? হবে না কেন? ফুলজান তো সুযোগ পেলেই বেটির মুখে ভাত ঠাসে, কেউ খাক কি না খাক, বেটিকে তার ঠিকই গেলানো চাই। সাধে কি ঘুড়িটার এরকম বাড়? যেভাবে বাড়ছে, এর বিয়ে দেওয়ার ভারও পড়বে হুরমতুল্লার ঘাড়েই। মাঝির পয়দা বেটিকে বিয়ে করবে কে? আবার রাতে বিছানা থেকে উঠে ঘুমের মধ্যেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে চায়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাচার তলে ঢুকে খুটখাট করে, গুড়গুড় করে হাঁটে। দাদার ব্যারামটা পেয়েছে, বড়ো হতে হতে ব্যারাম আরো বাড়বে না? তখন?-নাতনির বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বের গুরুভারে কিংবা নবিতনের শ্বশুরকে টাকা দেওয়ার ভাবনায় কিংবা দিনরাত পিপাসা পাওয়ার ব্যারামেও হতে পারে, হুরমতুল্লার মাথা নুয়ে নুয়ে পড়ে।