প্যাসেঞ্জাররা প্রায় সবাই নামে গাড়ি থেকে। পায়ে-হাজী মানুষটিকেও বেঞ্চের তলা থেকে কাকে কোদাল ঝুড়ি গুছিয়ে নিতে দেখে তমিজ জিগ্যেস করে, কামেত যাও? এটি কাম পাওয়া যাবি?
তমিজের সাফসুতরো পিরান আর লুঙি দেখে লোকটি একটু দোনোমননা করে, দেখা যাক। তবে তার সঙ্গীটি সাহস করে জিগ্যেস করে, তুমি কাম করবেন বাহে? তমিজ হুঁ বললেও তার ঝাড়া হাতপা দেখে তাদের সন্দেহ যায় না। তাকে কিছু না বলেই তারা নেমে গেলেও তমিজ কিন্তু তাদের পিছে পিছেই থাকে।
স্টেশনে ভিড়। আর একটা ট্রেন ঢুকলো। ধুতিপরা মানুষ, সিঁদুর মাথার মেয়েমানুষ অনেক। রেল লাইনের পাশাপাশি সবাই চলছে স্টেশনের ঘরের দিকে। টিনের ছাদ পার হয়ে চলে যাচ্ছে ওপারে। সেখানে রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি, গোরুর গাড়ি। রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে তমিজ হঠাৎ আঁতকে ওঠে : আরে নায়েববাবু! এখানেও নায়েববাবু? তার নজরে পড়লে তমিজের সর্বনাশ, তাকে ঠিক তুলে দেবে পুলিসের হাতে। তাকে এড়াতে তমিজ একটু দাঁড়ালে তমিজ শোনে নায়েববাবুর আঙুল ধরা ছোটো ছেলেটির কথা, বাবা, কৈ, ইনডিয়া কৈ বাবা? ওই তো স্টেশনের ওপারে। ওই যে রিকশা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। লোকটির কথা শুনে তমিজের ভুল ভাঙে, না, এটা নায়েবাবু নয়। হঠাৎ পেছন থেকে দেখলে নায়েববাবু বলেই মনে হয়। নায়েববাবু নয় এটা নিশ্চিত হলে তমিজের কদমে হাওয়া খেলে। লোকটার আঙুলধরা ছেলেটি ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে, ইনডিয়া কৈ বাবা? ও বাবা। লোকটির বাঁ পাশে সিথিতে সিদুর লাগানো বৌটা বলে, ওই তো বাবা, ওই যে। মেয়েটির কান্নাবসা গলার কথা ছেলেটির বিশ্বাস হয় না, কৈ? সব তো একইরকম। মায়ের চেয়ে বাপের ওপর তার আস্থা বেশি, ফের বলে, ও বাবা, ইনডিয়া কৈ? লোকটি ছেলেকে আর পাত্তা না দিয়ে বৌকে বলে, ইয়ে টিয়ে সব বাকসে, ব্যাগে ভাগ করে রেখেছো তো? গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হবে, ওদিকে চাষারা খুব উৎপাত করছে। নায়েববাবু তা হলে ইনডিয়ায় বিশেষ সুখে নাই। নায়েববাবু কিসিমের এই মানুষটার উদ্বিগ্ন মুখ ভালো করে দেখার লোভে তমিজ একটু পা চালিয়ে সামনে গিয়ে তার দিকে তাকায়।
লোকটি এবার কথা বলে তার পাশের সঙ্গীকে, এদিকে কিন্তু পুলিস প্রায় টাইট করে ফেলেছে। পাঁচবিবি জয়পুর একেবারে ক্লিন। পুলিসের বাড়ি না পড়লে কি আর বুলি কপচে কিছু কাজ হয়? সঙ্গীটি বোধহয় ইনডিয়ার খবর জানে বেশি, সে জানায়, আমাদের ওদিকেও পুলিস মার দিতে শুরু করেছে। তবে এদিককার লিডাররাও তো সব ওপারে গেছে, তাই একটু টাইম নিচ্ছে, ঠিক হয়ে যাবে।
পাকিস্তান ও ইনডিয়ার পুলিসের তৎপরতার কথা চলতে চলতেই কোমরে দড়িবাধা পনেরো-বিশজন মানুষের পাল নিয়ে পুলিশ বাহিনী বীরদর্পে এগোয় একটা ট্রেনের দিকে। তমিজ দেখে মুহূর্তে গোটা প্লাটফর্ম আর রেল লাইনগুলো থিকথিক করছে পুলিসে। কোদাল কাস্তে ঝুড়ি হাতে লোকজন ছুটতে শুরু করে; তারা এদিকে ছোটে, ওদিকে ছোটে। ভদ্দরলোকদের গায়েও লাগে, এমন কি ভদ্দরলোকদের বৌঝিদের গায়ে ধাক্কা দিয়ে তারা ছোটে।
ওই হাজা পা মানুষটা আর তার সঙ্গীরা যে কে কোথায় দৌড় দিলো চোখে পড়ে না। তবে পুলিস অনেকগুলোকে ধরেছে, ওদের খুঁজতে যাওয়াটা নিরাপদ নয়। পুলিস কিন্তু তার পাশ দিয়ে গেলেও তাকে খেয়াল করে না। হতে পারে, রাতে তার কাপড় যতোই দুমড়েমুচড়ে যাক, ইসমাইল হোসেনের পুরনো জামাতেও ভদ্দরলোকের দাগ খানিকটা হয়তো লেগেই রয়েছে। ওই জামার বুদ্ধিতেই তমিজ খামাখা দৌড়ায় না, দৌড়ালেই পুলিস সন্দেহ করবে।
প্ল্যাটফর্মের বাইরে একটা মালগাড়ির পেছনে এসে তমিজ দেখে, এখানে মানুষজন খুব কম। মালগাড়ির ওয়াগনের নিচে বেশ কয়েকটা কোদাল কাস্তে আর ঝুড়ি পড়ে রয়েছে। কয়েকটা পচুনও ঠেকানো রয়েছে ঝুড়ির সঙ্গে। নজর দিয়ে ভালো একটা কান্তে আর একটা কোদাল পছন্দ হলে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ঠোল্লাগুলো এখানে খুব পেটাচ্ছে, শালারা ঠাকুরগাঁয়ের দিকে পারে না, শোধ তোলে আমাদের এখানে এসে।
রেলের নীল জামাপরা একটা কুলিকে দেখে তমিজ জিগ্যেস করে, ও ভাই, ঠাকুরগাঁয়ের গাড়ি আসবি কখন?
সেভুন আপ ইহা আয়েগা সওয়া চার বাজে। উও গাড়ি জায়েগা দিনাজপুর তক। দিনাজপুর সে ফিন ঠাকুরগাঁও কা গাড়ি মিল সকতা।
ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষার পর প্যাসেনজার ট্রেন একটা এলে একজনকে জিগ্যেস করে তমিজ উঠে পড়ে পেছন দিয়ে। একটু হুঁশিয়ার থাকা দরকার। তার সঙ্গে এখন কাস্তে আছে, কোদাল আছে। পাঁচুনও একটা নিলেই হতো।
ট্রেন চলে। ঠাকুরগাঁয়ের গাড়ির কী একটা নাম বললো কুলি, সেটা তো মনে নাই। কিন্তু গাড়ি যেখানকার হোক, তমিজকে যেতে তো হবেই। হিলির গ্রামে গ্রামে এখন পুলিস। থাকা চলবে না। এই গাড়ি ঠাকুরগাঁয়ে না গেলে হয়তো নাটোর যাবে। নাটোর নেমে সুবিধা করতে না পারলে সে উঠবে নবাবগঞ্জের গাড়িতে। নাচোল যাবে। ওখানে তেভাগা কায়েম হয় তো বর্গা সে একটা ঠিকই জোগাড় করে নেবে। ফসলের হিস্যা যা জুটবে তাতে প্রথমেই খালাস করে নেবে ভিটা আর ঘর। এ ভিটায় তরকারির চাষ হবে ভালো। ফুলজান খাটবে ওই জমিতে, কুলসুম পারবে না। কুলসুম তার বেটিকে শোলোক শোনাবে আর তার বেটি শোলোক শুনতে শুনতে বেগুন খেতে নিড়ানি নিড়ানি। খেলবে। হুরমতুল্লার কাছ থেকে জমিটা নিয়ে সেখানে আউশের আবাদ করবে। দোপা জমি, আউশের এমন ফলন সে করবে যে আমনের খন্দকে ছাড়িয়ে যাবে। ট্রেন চলে।