শান্তাহারে গিজগিজ করে মানুষ। হিলির গাড়ি কোনটা কিংবা জয়পুর যাবে কোন গাড়িতে উঠে পাঁচজনকে জিগ্যেস করলে চারজনেই ছুটতে ছুটতে জবাব দেয়, জানি না। আর একজন চুপচাপ এগিয়ে যায়। ওভারব্রিজের ওপারে দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন যেটা দাড়িয়ে ছিলো বেশ ভিড় টির দেখে তমিজ চেপে বসলো তারই একটা কামরায়। মেঝেতে কোনোমতে বসবার জায়গা পেয়ে তমিজ বেশ খুশি। কিন্তু গাড়ি আর ছাড়ে না। কী ব্যাপার?-কয়েকটা স্টেশন পরে পুলিসের সঙ্গে মারামারি করে চাষারা সব রেল লাইনের ওপর গাছ কেটে রেখেছে। আরো পুলিস গেছে; মানুষ সাফ করে, গাছ সরিয়ে ওখান থেকে। সিগন্যাল দিলে জ্বলে উঠবে এখানকার সিগন্যাল। তবে না গাড়ি ছাড়বে। দেরি হোক, তমিজ উতলা হয় না। তবে খিদে পেলে ঢাকা মেলে ফেলে আসা ছালাটার কথা মনে হয়, পাঁচটা টাকা ছিলো। তবে ট্যাকে এখনো খুচরা খাচরা মিলিয়ে নয় সিকা মতো আছে, একটু রয়ে সয়ে খেলে কোথাও কাজ না পাওয়া পর্যন্ত এতেই চলে যাবে। গাড়িতে কোদাল কাস্তে ঝুড়িওয়ালা মানুষ আরো আছে, এদের কোনো একটা দলের সঙ্গে নেমে পড়লেই চলে।
সন্ধ্যার পর গাড়ি একবার চলতে শুরু করে খুব স্পিড নেয়। বড়ো লাইনের বড়ো কামরা, গতির সঙ্গে তাল রেখে দোলে। বাংকের ওপরের প্যাসেঞ্জাররা অঘোরে ঘুমায়, কেউ কেউ ঘুমায় সিটে বসে। মেঝেতে কুঁকড়েমুড়ে শুয়েও লোকজন ঘুমায় মহা সুখে। কেউ কেউ ঝিমায়। অনেকে হাই তোলে। গত রাত্রির ঝড়বৃষ্টি, জিনিসপত্রের দাম, কোথাও কোথাও বর্গাচাষাদের বাড়াবাড়ি, পুলিসের মারপিট, মন্ত্রীদের চুরিচামারি, ইনডিয়ার বদমায়েসি প্রভৃতি বিষয়ে মন্তব্য করতে গেলে হাই তোলার চাপে তাদের কথা বেরোয় বাকাচোরা হয়ে। ট্রেন ছোটে, ট্রেন ছোটে।
একেকটা স্টেশনে এক আধ মিনিটের জন্যে গাড়ি থামে আর তমিজের পাতলা স্বপ্ন। ভেঙে যায়। কোদাল আর কাস্তেওয়ালা মানুষদের কথাবার্তা থেকে বোঝা যায়, হিলির দিকে মাঠে মজুরি এখন বেশি, আপখোরাকি বারো আনা চোদ্দ আনায় উঠেছে। ঝুঁকি আছে বলেই মজুরি বেড়েছে। কেউ কেউ মনে করে, জোতদারদের হয়ে জন খাটাটাই ভালো। আবার কারো কারো ইচ্ছা অন্যরকম, বর্গাচাষাদের সঙ্গে ভিড়ে গেলে জোতদারগুলার পাছায় ডাং মারা যায়। পুলিসকে অতো ভয় পাবার কী আছে গো? ঠোল্লাগুলো অনেক মানুষের জোট দেখলেই বন্দুক ঘাড়ে নিয়ে পালায়।এইসব লোক হাই তুলতে তুলতেও আস্তে কথা বলতে পারে না, একটুতেই তাদের গলা চড়ে। তাদের কেউ কেউ আবার ঝিমাতে শুরু করে এবং ঘুমিয়ে পড়ে। তমিজের খিদে পায় এবং পাতলা স্বপ্ন কেটে গেলে মনোযোগ দিয়ে সে সবার কথা শোনে। জোতদারদের ডাং না মারলে ওরা তেভাগা দেবে কেন? পুলিসের তাড়া খেয়ে কোথাও যদি টিকতে না পারে তখন না হয় কেটে পড়বে আর কোথাও। চাষ আবার নাই কোথায়?
এদিকে একটু চেষ্টা করলেই এখন বর্গাজমি পাওয়া যাবে। জোতদার নিজের গায়ের মানুষকে বিশ্বাস করে না, পুব থেকে, দক্ষিণ থেকে আসা চাষাদের জমি দিয়ে ভাবে, এরা গোলমাল করবে না। বর্গাদার চাষা হলে অবস্থা ফেরাতে আর কতোদিন? তেভাগাটা হয়ে গেলে ধান বেচে যা থাকবে তার সঙ্গে কাদেরের কাছে জমা রাখা টাকাটা মেলালে তার ঘরভিটা খালাস হয়। তারপর ধরো কামারপাড়ার অনেকে তো যাবার তালে আছে, সেখানে কিছু জমি রাখা যায় সস্তায়, তারপর —। ঘুম আর রেলের দুলুনিতে তার হিসাব এলোমেলো হয়ে যায়। ঠাকুরগাঁ না নাটোর না নাচোল না-কি হিলির দিকেই চাষাদের মার দিলেও তাদের জোট এখনো ভাঙে নি। আর কোথাও না হোক ওদিকটায় তেভাগা হবেই। ধরো ওদিকে কোথাও যদি জমি বর্গা পায় তো গোরুবাছুর কিনতে আর কতদিন? তারপর হুরমতুল্লার ভিটার পেছনে না গিয়ে তমিজ চলে যায় তার নিজের খালাসকরা ভিটার জমিতে। সেখানে তরিতরকারি করা যায়। আলু করো, বেগুন করো। বেগুনবাড়ির ওপর মাচা তুলে লাউ করো, ঝিঙা করো, সিম করো, শশা করো। ফুলজানকে লাগানো যায় ওখানে। আর তার বেটিটা ট্রেনের দুলুনিতে দুলুনিতে বড়ো হতে থাকে, তা হলে বেটিও থাকবে তার পাশে পাশে। পাঁচুন দিয়ে খেলতে খেলতেই বেটি বসে পড়বে তার পাশে। ছোট্টো ছোট্টো হাতে ঘাস আগাছা ওপড়াতে গিয়ে বেগুনচারার গোড়া কেটে ফেললেও তমিজ একটুও রাগ করবে না। ফুলজানের পেটের মেয়ে তো, দেখো, দেখো তোমরা, হামার হাঁটু সমান হতে না হতে বেটি হামার ক্যাংকা করা জমি লিড়ায়। তা কুলসুম একটু রাগ করতে পারে। দাদী তো, কথা একটু শোনাবেই।—মাঝির ঘরের বেটি হয়া জাল চেনে না, একটা জালের নাম কবার পারে না। খালি জমিত জমিত ঘোরে।-কথা তমিজও কি আর কম জানে? রাত্রি কেটে চলা ট্রেনের দোলায় তার ঠোঁটজোড়া একটুখানি ফাঁক হলে, সেটাকে হাসি বলেও চালানো যায়, হাসিটা টিকিয়ে রেখেই সে বলে, তুমিও তো বাপু মাঝির ঘরের বৌ। বাঘাড় মাঝি আছিলো তোমার দাদাশ্বশুর। জালের খবর তুমি কিছু রাখিছো? ঘুম কিংবা তন্দ্রার মধ্যেই তার ঠোঁটের হাসি নিভে যায়, ঠোট না নড়িয়েই তমিজ নালিশ। করে, তুমি খালি থাকিছো লিজের দাদাক লিয়া। বলতে না বলতে গাড়ির ঝিকঝিক ঝিকঝিকে বাজে নতুন আওয়াজ। কে বাজায় গো?-কুলসুম ছাড়া আবার কে? তমিজের বেটিকে কোলে নিয়ে কুলসুম শোলোক বলছে, শোলোকের কথা বোঝা মুশকিল। শোলোকের টানে টানে গাড়িতে উঠে আসে তমিজের বাপ।-না তমিজের বাপ কোথায়? কুলসুমের লম্বাটে মুখেই বালি ঝুরঝুর করে। তা হলে তার মুখে দাড়ি গজাবে নাকি? কুলসুম এমন করে ঢুলছে কেন? তমিজের বাপ কি তার সব নিন্দ আর এলোমেলো খোয়াব সব সেঁধিয়ে দিয়ে গেছে তার দুই নম্বর বিবির চুলভৱা মাথায়? আর কুলসুম আবার শোলোকে শোলোকে সেগুলো দিচ্ছে তমিজের বেটির কচি মাথার ভেতরে? না গো, ইগলান ভালো লয়। ঐ তো, শোলোকের আসর বেশ জমে উঠেছে। না হলে বৈকুণ্ঠ আসে কেন? কুলসুমের গলার ভেতর দিয়ে আসা তমিজের বাপের ঘুমঘুম কথা আর চেরাগ আলির শোলোক শুনতে শুনতে বৈকণ্ঠ মাথা দুলিয়ে তাল দিচ্ছে। কিন্তু কুলসুমের শোলোকের কথা তো বোঝা যায় না।ও বৈকুণ্ঠদা, তুমি ইগলান হাবিজাবি কী। শোনো গো? ঢুলতে ঢুলতেই বৈকুণ্ঠ জবাব দেয়, তোর বাপেক পুস কর ঘোড়া। কিন্তু তার বাপ কোথায়? তমিজ এদিক ওদিক তাকালে বৈকুণ্ঠ চোখের ইশারায় দেখিয়ে দেয় কুলসুমকে। তবে বাপ কি তার ঢুকে বসে আছে কুলসুমের গতরে? বাপকে খুঁজতে কুলসুমের গতর ছাড়া তার আর উপায় নাই, আর পথ নাই, কোনো বুদ্ধি নাই। তাইতো, একদিন রাতে, সেটা কবে গো?–বাপ মরার দিন, না-কি আরো পরে, বাপের শোকে একটা নুনের পোটলা হয়ে তমিজ শুয়েছিলো বাপের মাচায়। কেবল তখুনি, সেই একবারই বাপ তার কাছে এসেছিলো। কুলসুমের হাতের ভেতর দিয়ে, তার উঁচু বুকের ভেতর দিয়ে তার উরুতে ভর দিয়ে, তার কোমরে আসর করে বাপ এসে তাকে টেনে নিয়েছিলো নিজের কালোকিষ্টি গতরের মধ্যে। সেটা কবে যেন? বৈকুণ্ঠকে বাপের এই কারসাজির কথাটা বললে হয়। বাপজান তার কাছে আসে না কেন? বাপকে ধরতে হলে তাকে যেতে হবে কুলসুমের ভেতর দিয়ে, এটা কেমন কথা? বৈকুণ্ঠকে সে নালিশ দেবে, মরার পর বাপজান নিত্যি কুলসুমের কাছে আসে, তার সঙ্গে ফুসুরাসুর করে। কিন্তু বেটাকে তো কোনোদিন উঁকি দিয়েও দেখে না। বৈকুণ্ঠদা, ওই ফকিরের বেটিক না ধরা কি বাজানেক ধরার কোনো বুদ্ধিই নাই?—কিন্তু তার জবাব শোনার আগেই ট্রেনের ঝিকঝিক আওয়াজ জমাট বেঁধে ফেটে পড়ে বাজপড়ার শব্দে। পোড়াদহ মাঠে বটগাছের ঝাঁকড়া মাথায় আগুন ধরে গেলো নাকি? সন্ন্যাসীর থানে খালি ছাই আর ছাই। বৈকুণ্ঠ কি বসেছিলো ওখানেই? মানুষটা বড়ো গোঁয়ার। একেবারেই সাবধান থাকতে চায় না। এই কথা ভাবতে না ভাবতে বৈকুণ্ঠ বলে ওঠে, হামাক হুঁশিয়ার থাকা লাগবি কিসক রে? এই যে গিরিরডাঙা আর নিজগিরিরডাঙা, এই যে গোলাবাড়িইগলান জায়গাত ওই সময় কোম্পানির পাছাত ডাং মারিছিলো কেটা? ক তো কেটা? ভবানী সন্ন্যাসীর সাথে আসিছিলো আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদার বাপ, না-কি তার ঠাকুরদাই হবি। কথা শেষ করার আগেই সে ঢলে পড়ে তমিজের বুকে। বৈকুণ্ঠের সারা শরীর পুড়ে অঙ্গার। ছাইয়ের ভেতর থেকে তবু কী করে সে বেরিয়ে এসেছে ওই পোড়া শরীর নিয়ে। তার শোলোকে-ভারী মাথার ওজনে তমিজের বুক টনটন করে। ঘুম ছুটে গেলেতমিজ তার পাশে শুয়ে-থাকা মানুষটির হাজা-ধরা পায়ের ভারি পাতা সরিয়ে দেয়। নিজের বুক থেকে। তখন ভোর হচ্ছে। গাড়ি থামলো হিলি স্টেশনে।