কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামে ঝমঝম করে। খবর পেয়ে টমটম নিয়ে তহসেনউদ্দিন আসে টাউন থেকে। বাপকে নিয়ে সে চলে যায় টাউনে; হরেন ডাক্তার বলো আর করিম ডাক্তার বলো-এদের কারো ওপরেই তহসেনের ভরসা নাই। বুধাকে সে কড়া হুকুম দিয়ে যায়, আমতলি থেকে পুলিস না আসা পর্যন্ত লাশ যেখানে যেভাবে ছিলো। তেমনি থাকবে। কেরামতকে আচ্ছা করে বেঁধে রাখা হলো কালাম মাঝির খানকা ঘরে।
মাঝিপাড়ার মানুষ অনেকদিন পর একেবারে ভেঙে পড়ে কালাম মাঝির বাড়িতে। তমিজের বাপের মতো মানুষ, যে কি-না ঘরসংসার তুচ্ছ করে চেরাগ আলির পাছে পাছে ঘুরলো সারাটা জেবন, তামাম এলাকার মুরুব্বি মুনসিকে এক নজর দেখতে গিয়ে তার আরস খুঁজে না পাওয়ার কষ্টে ঢুকে পড়লো চোরাবালির মধ্যে, এ্যা, তারই বৌ এবং চেরাগ আলি ফকির, মুনসির খাস খলিফা, যে কি-না সারা জেবন খালি শোলোকে শোলোকে মুনসির শাস্তরই গেয়ে গেলো, তার সাক্ষাৎ নাতনিকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে গিয়ে জখম হয়েছে কালাম মাঝি। কালাম মাঝির দুঃখে লোকজন ভেঙে পড়ে। এমন কি, তার বিলডাকাতির মামলায় এখনো হাজতখাটা মাঝিদের আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত কালাম মাঝির ডান কনুইটা ডান হাতেই ঠিকমতো জোড়া লাগাবার জন্যে কুদুস মৌলবির নেতৃত্বে আল্লার দরবারে কান্নাকাটি করে। চাষীপাড়ার মানুষ আসে, পালপাড়া থেকে আসে কেষ্ট পাল তার ভাই আর ভাইপোকে নিয়ে। শরাফত মণ্ডল আর কাদের একবার ঘুরে গিয়ে বাড়ি থেকে হ্যাজাক পাঠিয়ে দেয়।
আমতলি থেকে পুলিস আসতে আসতে পরদিন বেলা এগারোটা। তমিজের বাপের ঘর এবং ঘরের বাসিন্দা বৃষ্টির পানিতে ভিজে একসা। মাচার ওপর এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে তলার দিকে একটা শুকনা কাঁথা পাওয়া যায়। লাল নীল সবুজ ও হলুদ সুতাতে চারদিকে বরফি তোলা কাথার মাঝখানে অনেকগুলি চাঁদ এবং একোটা চাঁদ পিছু তিনটে করে তারা। সেই কথায় জড়িয়ে কুলসুমের লাশ ফের মোড়ানো হয় বাঁশের চাটাইতে। চাটাই জড়ানো লাশ বাঁশে ঝুলিয়ে কাঁধে তুলে নিয়েছে মাঝিপাড়ার দুজন তাগড়া জোয়ান। লাশের আগে পুলিস, পিছে পুলিস। পেছনের পুলিসের হাতে ধরা কেরামতের কোমরে দড়ি। তার হাতেও হ্যান্ডকাপ পরানো।
রাতভর মাঝিপাড়ার আবাল বৃদ্ধের হাতে কিলচড়লাথি খেয়ে সে খুব দুর্বল। তার ঢুলঢুলু চোখে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে বাঁশের চাটাই থেকে বেরিয়ে-পড়া কুলসুমের পায়ের পাতা। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে পায়ের পাতাজোড়া ফ্যাকাশে, একটু ফোলা ফোলা। কাঁথার চাঁদতারা লুটিয়ে পড়েও সেখানে একটু আলো ফেলতে পারে না। কেরামতের মাথা এখন ভারী, তার মাথার ধারে কাছেও কোনো শোলোক নাই। কিন্তু কে বলতে পারে, জেল খাটতে খাটতে কিংবা ফাঁসির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আরো সব চোর ডাকাত আর জোট-বাঁধার-দায়ে-কয়েদখাটা উত্তরের চাষাদের সঙ্গে বসে কেরামত তার ওই শোলোকটায় আরো কথা জুড়বে না? শোলোকটা প্রথম থেকে বললে হয়তো শোনাবে এরকম :
কদাপিও রূপ যদি দেখে থাকি কোথা।
খোয়বে ও মুখখানি নাহিক অন্যথা।।
মুনসির আরস নাই পাকুড়ের তলে।
বিধ মাঝি হাঁকে রূপ ভেসে যায় জলে।।
কয়েদখাটা কোনো চোর কি ডাকাত কি জোটবাঁধা চাষাদে কেউ হয়তো জানতে চাইবে, এই শোলোক তুমি কুটি পাঁছো গো?
হামার লিজের বান্দা শোলোক। শোলোক হামি লিজে বান্দি।-কেরামত আলি কি তখন এই জবাব দিতে পারবে? পাকুড়গাছশূন্য পাকুড়তলা কি তার বুকে ছমছম করবে না?
তবে আজ কালাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়গাছশূন্য পাকুড়তলা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ছমছম করার মতো জায়গা কি ফুরসৎ ফুলজানের বুকে হয় না, সেখানে তার বেটির মুখ লাগানো।
সকালে ফুলজান সৎশাশুড়ির লাশ দেখতে মাঝিপাড়ায় যেতে চাইলে হুরমতুল্লা খুব করছিলো : এইসব খুনখারাবির ব্যাপারে গেলেই ঝামেলা। পরে শরাফত মণ্ডল ও আবদুল কাদের পুলিসের দেখাশোনা করছে খবর পেয়ে তার সাহস হয় এবং একটু ভয়ে ভয়ে হলেও বেটিকে নিয়ে হাজির হয় কালাম মাঝির মানুষ গিজগিজ-করা বাড়িতে। ততোক্ষণে লাশ জড়ানো হয়ে গেছে বাঁশের চাটাইতে। শরাফতের বাড়ি থেকে ভাত ও মুরগির গোশতের তরকারি নিয়ে যাওয়া প্রভৃতি কাজে হুরমতুল্লাহ হাত লাগায়। লাশ নিয়ে পুলিস রওয়ানা হলে সে মণ্ডলবাড়ি গিয়ে চারটে ভাতও খায়।
ফুলজান অনেক দূর থেকে লাশ ও কেরামতের পিছে পিছে গিয়েছিলো। তারপর বাঁদিকে ইটখোলা দিয়ে সে ধরে বাড়ির রাস্তা। বাঙালি নদীর রোগা স্রোতের ওপর বাঁশের সাঁকোটা কাল রাতের ঝড়ে ভেঙে গেছে। স্রোতে পানি বেড়েছে অনেকটা। এটা পেরোতে ফুলজানের কাপড় তুলতে হয় প্রায় উরুর ওপর। বাঙালি নদীর রোগা স্রোতে কেরামতের মার-খাওয়া মুখ ভেঙে ভেঙে যায়। এদিকে বুকের দুধ না পেয়ে কোলের বেটিকে কান্না থামাতে এবং ওদিকে কাল রাতে ফের বৃষ্টির পর ভিটার পেছনে আউশের জমিতে ধানশীষগুলো দেখার তাগিদে কদমে বাদাম না খাটিয়ে নিয়ে তার আর উপায় নাই।
৫৭. শান্তাহারের ট্রেন ছোটে
শান্তাহারের ট্রেন ছোটে। খিয়ারের মানুষ সবাই মাঠে নেমে গেছে। মেঘলা আকাশের নিচে বৃষ্টি-ভেজা মাটি আর কিছু না হোক ছানতেও সুখ। স্টেশনে স্টেশনে গাড়ি থামে, লোকাল ট্রেন, স্টেশন না পেলেও মাঝে মাঝে থেমে জিরিয়ে নেয়। লোক নামে, ওঠে। তমিজ নতুন যাত্রীদের হাতের দিকে দেখে, মাটির দাগ দেখলে তার হিংসা হয়।