ভাঙাচোরা বাড়ির পেছন দিয়ে হুবহু কালাম মাঝির পথ ধরেই সে পৌঁছে গেলো কুলসুমের ঘরে। ঝাপোলা ঘরের ভেতর ঢুকলে কেরামতের নজর আটকে যায় ঘাম চপচপ সাদা রঙের পাঞ্জাবিপরা পিঠের ওপর। কালাম মাঝি উপুড় হয়ে বসেছে কুলসুমের বুকের ওপর। সে কি তাকে চুমু খাবার চেষ্টা করছে? তার পিঠে পড়ছে কুলসুমের অবিরাম লাথি। ওই লাথি কি শালা মাঝির পিঠকে কাবু করতে পারে? না, মাঝির বেটা সুখই পাচ্ছে।
কুলসুম গলায় জোর খাটিয়ে বলে, খাড়া হয়া থাকো কিসক? কিন্তু কালাম মাঝির ভারি ভারি হাত দুটোর নিচে চাপা পড়েছে কুলসুমের মুখ। কেরামত বুঝতে পারে, কুলসুম তো তাকেই ডাকছে, কালাম মাঝির হাত থেকে বাঁচাতে কুলসুম তারই সাহায্য চায়। কালাম মাঝি বলছে, কুলসুম, তুই হামাক মাফ কর। তুই হামার চাচি, হামি তোর নামে এই ঘর লেখ্যা দিমু, সম্পত্তি চাস তো আরো দিমু। তুই তমিজের বাপোক এটি থ্যাকা যাবার ক। হামি ভালো করা দোয়াদরুদ পড়ায়া দিমু, তাক তুই যাবার ক।
পাকুড়তলার ভয়ে তার শরীরের বল অনেকটা ক্ষয় হওয়ায় কিংবা তমিজের বাপকে এক্ষুনি চলে যেতে বলার জন্যে সুযোগ দিতেও হতে পারে, কুলসুমের মুখের ওপর চাপা দেওয়া হাত তার একটু শিথিল হয়ে গিয়েছিলো। সেই সুযোগ কুলসুমের কথা বেরিয়ে আসে তার খুব দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে, হামাক ম্যারা ফালালো গো। তুমি আবোরের লাকান ওটি খাড়া হয়া থাকো কিসক? তুমি, তুমি।
তাকে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু কুলসুম ভরসা করছে তারই ওপর। তার তুমি তুমি কেরামতকে খুশিতে, কষ্টে, গ্লানিতে, গৌরবে, উত্তেজনায়, উস্কানিতে, এমনকি বলা যায় না, হয়তো প্রেরণাতেও এমনি বলকাতে শুরু করে যে শরীরের সমস্ত বল দিয়ে সে দুই হাতে ধাক্কা দেয় কালাম মাঝির পিঠে। তারপর ওই হাতজোড়া দিয়েই টেনে ধরে কালাম মাঝির গলা। তমিজের বাপ এবার কুলসুমের ডাকে সাড়া দিয়েছে কালামও তাই বুঝতে পেরে নিজের গলা থেকে বুক পর্যন্ত চেপে ধরে কুলসুমের মুখের ওপর। কুলসুমের নাকমুখ এমনভাবে চেপে ধরেছে যে তার পক্ষে কাউকে ডাকা দূরের কথা, নিশ্বাস নেওয়া পর্যন্ত অসম্ভব। কুলসুমের ডাক কেরামত আরেকবার, অন্তত আর একবার শুনতে চায়। সুতরাং উপুড় হয়ে কালাম মাঝির ঘাড়ের ওপর দিয়ে হাত ডিঙিয়ে তমিজের বাপের মাচার দ্বিতীয় খুঁটির পাশ থেকে টেনে নেয় শিঙি মাছের রক্তমাখা বঁটি। বঁটির ধাক্কায় মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে জ্যান্ত শিঙিওয়ালা পানিভরা মটকা। পানিতে ভিজে যায় কুলসুমের চুল। মাটিতে কিলবিল করে তিনটে শিঙি মাছ। কুলসুমের চুলে গড়ানো আঁশটে গন্ধের পানিকে একটি শিঙি ঠাওরায় কাৎলাহার বিলের অংশ বলে এবং বোকার মতো ঢুকে পড়ে সেই কেশরাশির ভেতর। সেটা কালাম মাঝির নজরে পড়লে তার বুক কাঁপে আরেক পশলা : এটা কি শিঙিমাছ? না-কি আজকেই হুরমতুল্লার ঘরে দেখা সেই গোখরোটা? কিংবা তার জোড়া? কান্তাহার বিলের এপারে ওপারে সব জীবের মতো। এটাও তো মুনসির শাসনেই থাকে। মুনসিই কি এটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে তমিজের বাপের খেদমতে। তারপর পুরো বিলে ড়ুবসাঁতার দিয়ে শালার সাপ এসে হাজির হয়েছে কালাম মাঝিকে কাটতে। তমিজের বাপ, বৈকুণ্ঠ, সেই কোন আমলের মুনসি, চেরাগ আলি ফকির, এদের সঙ্গে এসে জুটলো হুরমতুল্লার বাড়ির গোখরোটা। কালাহারের সব মরা জীবের ভয়ে, তাদের সহকর্মী এই গোখরা সাপের ভয়ে কালাম মাঝি আরো জোরে চেপে ধরে কুলসুমের মুখ। সেখানে কোনো স্পন্দন নাই। মেয়েটা কি মরে গেলো নাকি? তা হলে? কুলসুমও যদি মরে তো এই ঘরভরা মড়াকে সে একা ঠেকাবে কী করে? আবার মাটি থেকে বঁটিটা চলে গেলো কার হাতে? তমিজের বাপের হাতে এখন হাতিয়ার, কালাম মাঝির এবার সব শেষ।
তবে পলকের ভেতর কালাম মাঝির কাণ্ডজ্ঞান ফিরে আসে, তার মনে পড়ে, লোহার কোনো কিছু কাহারের তেনাদের সাধ্যের বাইরে। তা হলে এই বঁটি তুলে নিয়েছে নির্ঘাৎ তমিজ। তমিজ না হলেও তার ওইসব জোট-বাঁধা চাষাদেরই কেউ হবে। সতর্ক হয়ে কালাম একটু ঘাড় সরিয়ে নিতেই বঁটির একটা কোপ পড়ে তার ডান হাতের কনুইতে। দ্বিতীয় কোপটি পড়ার আগেই সে ছিটকে সরে পড়ে অনেকটা বাঁয়ে। বঁটির এই কোপটি পড়ে কুলসুমের বাম স্তনের মাঝখানে। সেখান থেকে এবং কালামের কনুই থেকে রক্ত ঝরতে থাকে গলগল করে। দুজনের রক্ত গড়ায় মেঝেতে, বঁটিতে শিঙি মাছের শুকনা রক্ত এই দুজনের টাটকা রক্তে জেগে ওঠে লাল রঙে।
কুলসুমের গলা থেকে ঘর্ঘর শব্দ বেরুচ্ছিলো কালাম যখন তার মুখ ঠেসে ধরে তখন থেকেই। এখন তার স্তনের ওপর বঁটির ঘা পড়লে ফের আঁ আঁ করে কাত্যায়।
কালাম মাঝি ততোক্ষণে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কনুইতে তার জখম বেশ মারাত্মক। অন্য হাতে সেই হাত চেপে ধরে কেরামতের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমে তাকে চিনতে পারে না। কেরামত তাকিয়েছিলো কুলসুমের মুখের দিকে। তার হাতে বটি তখনো ঝুলছে। কয়েক পলকের জন্যে তার চোখে কুলসুমের মুখে গোলাপি আভা দেখতে পায়, টাউনের রিফিউজি ক্যাম্পে দেখা ঐ রিফিউজি মেয়েটির কোন স্তনটি যেন কাটা ছিলো? বাকি স্তনটা কি কাটা পড়লো কেরামতের হাতে?
কেরামতকে কেরামত বলে চিনতে পেরে দারুণ অবাক হতে হতেও যন্ত্রণা, দুঃখ ও ভয়ের মাত্রাছাড়া চাপে কালাম মাঝি কোনো কথাই বলতে পারে না। তারপর সে অবশ্য খানিকটা সামলে নেয় এবং কুলসুমকে ডিঙিয়ে দরজার হুড়কো খুলে ছুটতে ছুটতে বলে। খুন খুন! কিন্তু গলায় তার জোর নাই।