কুলসুমের চোখের ইশারা কিংবা তার শুকনা খরখরে গলা অথবা দুটোতেই কালাম মাঝির শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। এর সঙ্গে একটু আগে কুলসুমের মোলায়েম স্বরের কথা শুনে তার গায়ে মোলায়েম ছোঁয়ার কোনো মিল নাই। তমিজের বাপ কি সত্যি এসে পড়েছে নাকি? মানুষটা তো আচ্ছা নেমকহারাম গো! চোরাবালিতে প্রতি জুম্মার পর তার গোর জিয়ারত করাচ্ছে কালাম মাঝি, কুদুস মৌলবিকে দিয়ে কোরান খতম করিয়ে তার নামে বকশা করে দেওয়া হয়েছে কয়েকবার। এর পরেও সে শান্তি পায় না? দুনিয়ার টান তার যায় না? কুলসুমের উঁচু বুক আর লম্বাটে মুখ নিজের চোখ দুটো ভরে দেখার চেষ্টা তার ব্যর্থ হলে কালাম মাঝি বলে, কলেই হলো? মুনসিই বলে ভাগিছে পাকুড়গাছ লিয়া, তমিজের বাপ আসবি কার ঘাড়োত চড়া?—নিজের ঠাট্টাবিদ্রুপে সে নিজেই ভয় পায় এবং এই ভয় কাটাতে ফের বলে, ওই যে বৈকুণ্ঠ, শালা মালাউনের বাচ্চা, ওটাও তার পাছ ধরিছে নাকি?—এমনিতে শরিয়ত মোতাবেক দাফন না-হওয়া মুসলমানের বেচইন রুহ, এর ওপর খুন-হওয়া হিন্দুর অতৃপ্ত প্রেতাত্মার কথা বলে কালাম এই ঘরে ছায়া ঘনিয়ে তোলে; সে আটকায় আরো প্যাচের মধ্যে : এই ঘরে সে কি বসে রয়েছে রুহু আর প্রেতাত্মার মধ্যে? মরার পরেও শালাদের জোট ভাঙে না? আর কুলসুম কি এদের বাঁদি? নাকি সে হলো এদের সর্দারনি?-না তাকে তারা দুনিয়ায় তাদের খলিফা। নিযুক্ত করেছে? তাদের বাঁদি, সর্দারনি আর খলিফা যাই হোক, এইসব ভূত পেতের মধ্যে একমাত্র মানুষ হলো কুলসুম। কুলসুম ছাড়া কালাম মাঝিকে এখন ঠাঁই দেবে কে? আর কে আছে?-কালাম ঠিক বুঝতে পারে নি, কখন পাছা ঘষটে এসে পড়েছে কুলসুমের গায়ের কাছে, তার বঁটি ঘেঁষে।
কুলসুম হঠাৎ বলে ওঠে, আপনে এটি কাক উটকান? তমিজ তো গাও ছাড়িছে আর বছর। উই কি আর এই মুলুকেত আছে?
এই সময় বাইরে ভ্যা ভ্যা করে ডেকে ওঠে একটা ছাগল, দুজন মানুষ কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে ডোবার ওপারের রাস্তা দিয়ে। জীবিত জানোয়ার ও মানুষের আওয়াজে কালাম বল পায়, ওই আওয়াজের ভেলায় চড়ে বসতে তার জানটা আকুলিবিকুলি করে। কুলসুম বোধহয় ভয় পাচ্ছে তাকে, ব্যাকুল হয়ে মেয়েটা বারবার তাকাচ্ছে মাচার দিকে। ওদিকে ছাগল ও মানুষের গলার স্বর দূরে মিলিয়ে গেলে বিজলির ধমকে-ঝলসানো ঘনঘোট আন্ধারের মতো ঘরের নীরবতা বাড়ে একশোগুণ, কালামের ভয় বাড়ে তার চেয়েও বেশি, একশো হাজার গুণও হতে পারে। আল্লা গো, মা গো বলে সে জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করে কুলসুমকেই।
কালাম মাঝির ধাক্কায়, বরং বলা যায় তার ভারে কুলসুম মাটিতে গড়িয়ে পড়তে পড়তে হাত দিয়ে ঠেলে দেয় বঁটিটাকে। শিঙি মাছের রক্ত ও নাড়িভুড়িমাখা বঁটি পড়ে থাকে মাচার দ্বিতীয় খুঁটির গা ঘেঁষে। চিৎ হয়ে পড়ে গেলে দরজার বন্ধ কপাটে মাথা ঠেকে কুলসুমের, মাচার দিকে তাকিয়ে সে নালিশ করে, দেখো তো, মানুষটা হামার সাথে কী করিচ্ছে? খাড়া হয়া তুমি কী দেখো? এবার কুলসুমকে জড়িয়ে না ধরে কালামের আর কোনো উপায়ই থাকে না। আলগা করে ধরেও তার ছমছমে ভাবটা কিন্তু একটু কাটে। এখন একে জাপটে ধরতে পালেই জ্যান্ত ও মরা মানুষের নজর থেকে, তাদের থাবা থেকে কালাম বাঁচে। কুলসুম অবিরাম কিল মারতে শুরু করে তার বুকে, পেটে, এমন কি চিবুকে পর্যন্ত। কুলসুমের হাতের ঘায়ে এতো জোর কি আর থাকতে। পারে? মরিয়া হয়ে কালাম উপুড় হয়ে ধরে ফেলে কুলসুমের দুই বাহুমূল এবং চটকা মেরে উঠে বসে তার বুকের ও পেটের মাঝামাঝি। কুলসুম ফের নালিশ করে সামনের দিকে তাকিয়ে, তুমি খালি খাড়া হয়া থাকবা? দেখো না হামাক কী করিচ্ছে! এই মানুষটাক তুমি আটো করবার পারো না?
কালাম মাঝি পেছনদিকে না তাকিয়েও শুকনা গলায় বলে, তমিজের বাপ, তোমার। নামে হামি মিলাদ দিমু, তোমার নামে দোয়া পড়ায়া হাজার মানষেক খিলামু। তুমি মানুষের মধ্যে আরো আসো না। তোমার রুহের মাগফেরাত চায়া গাঁয়ের ব্যামাক- তমিজের বাপের প্রতি এই মিনতিতে কাজ হয় না। বরং কালাম মাঝির পিঠে পড়তে থাকে একটির পর একটি লাথি, মরা মানুষের পা ছাড়া এমন আবছা আবছা লাথি আর কে দিতে পারে?
ওদিকে কালাম মাঝিকে দেখেই কেরামত আলি তার বাবরি চুল, ময়লা বেনিয়ান ও সবুজ লুঙি নিয়ে বিজলির মতো ছিটকে গিয়েছিলো তমিজের বাপের ঘরের পেছনে ভাঙা কাঁঠালগাছের দক্ষিণে, সেখানে শরাফত মণ্ডলের বর্গাচাষা শমশের মরিচের জমি তৈরি। করে। শমশের তখন জমিতে নাই, কেরামত দাঁড়িয়ে হাঁপায়। অস্থির হয়ে ভাঙা কাঁঠালগাছের পাশে এসে শুনতে পায় কালাম মাঝি আর কুলসুমের কথা, কালাম মাঝি মনে হয় কুলসুমের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে। এখন কেরামত করেটা কী? কালাম মাঝি হলো তার অন্নদাতা, কালামের বাড়িতেই সে থাকে। কুলসুমের সঙ্গে তার নিকা দেওয়ার ইংগিতও তো দিয়েছিলো কালামই। এখন অবশ্য সে কথা সে তোলেই না, বরং কুলসুমের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেখলে ভুরু কোঁচকায়। যতোই হোক, কালাম মাঝির ওপরেই তাকে চলতে হবে, তার রেজেক বলো রোজগার বলো সবই কালাম মাঝির হাতে। এই নিশ্চিত রোজগারটি না থাকলে তার গান লেখাও আর কখনো হবে না। গোলাবাড়ি হাটে মুকুন্দ সাহার দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একহাট মানুষের সামনে কেরামত যে গান করেছিলো, সেটা কালাম মাঝির তাগাদা ছাড়া কি হতে পারতো? এখন কুলসুমকে তার হাত থেকে বাঁচাতে যাওয়া মানে ওই মানুষটার সঙ্গে নেমকহারামি করা।-কেরামত কী করে?–ভাঙা কাঁঠালগাছের নিচে সে বসলো পেচ্ছাব করতে। বেগ ছিলো না, পেচ্ছাব তেমন হলোও না। এখন পেচ্ছাব করার পর তার আরো কোনো কিছুই করার নাই। তার পেচ্ছাবের ফেনার বুদবুদ সব মিশে যায় আর কেরামতের বাবরি চুলের নিচে লাগে কুলসুমের বড়ো বড়ো নিশ্বাসের ঝাপটা, গরম হাওয়ায় তার চুল ওড়ে। কেরামতকে কুলসুম দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু আড়ালে থাকলেও তার নিঃশ্বাসে কেরামতের এখানে এই কাঁঠালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সে ঠিকই কিন্তু ঠাহর করতে পাচ্ছে। এক্ষুনি তার ঘরে ঢোকাটা খুব জরুরি। কুলসুমের একটা কাজে যদি সে আসে তো মেয়েটা তাকে কি আর ফিরিয়ে দিতে পারবে?