কুলসুমের পরের প্রসঙ্গটি নতুন, উদিনকা বুধাও কচ্ছিলো, তমিজ বলে কুটি গেছে। চাষাগোরে সাথে জোট বান্দিবার। খালি হুজ্জত, খালি হুজ্জত। হুজ্জতের মধ্যে থাকবার না পালে তোমার বেটার প্যাটের ভাত হজম হয় না। তা তার বৌবেটি নাই? বৌবেটিক ভাত দেওয়া লাগে না? হামি না হয় ফকিরের বেটি, বানের সাথে ভাসা আসিছি। বৌবেটি? বৌ ভাত না পালে দেখো, ঐ ঘেগি মাগী আবার কার সাথে লিকা বসে।
কালাম মাঝির কান শিরশির করে। ঘরের মধ্যে লোকটি তবে কে? একবার ভাবে। ফিরে যাই। সঙ্গে সঙ্গে সে বল সঞ্চয় করে, না তমিজের খবর জানতে হলে এক্ষুনি ঘরে ঢোকা দরকার। লোকটা যে-ই হোক তমিজের সঙ্গে তার সাট আছে। আবার কুলসুমের গলার মিহি আওয়াজ একটু মুশকিলেও ফেলে। মেয়েটির এই রিনিঝিনি বোল তার কানে ঢুকে গোটা শরীরে মোলায়েম মালিশ করে দিচ্ছে, দরজার কপাট থেকে কান সরিয়ে নেওয়া তার জন্যে বড়োই কঠিন।
কিন্তু আসামির হদিস করার কর্তব্যবোধ তাকে কুলসুমের কথার গুড়ে সেঁটে থাকতে দেয় কী করে?
নতুন পাম্পগুজোড়া আস্তে করে খুলে, হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে পেছন দিক দিয়ে তমিজের ভাঙা ঘর পেরিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো রোদে-ভাসা উঠানের ওপর। কুলসুমের ঘরের ঝাপ খোলা। পা দুটো টিপে টিপে ভেতরে ঢুকে ঘরে অনধিকার প্রবেশকারী আসামিকে কীভাবে এক ঝটকায় ফেলে তাকে জাপটে ধরবে কালাম মাঝি সেই ফন্দি আঁটে। সঙ্গে তার অস্ত্র নাই, জুতোজোড়া রেখে দিয়েছে উঠানের কোণে। ভরসা শুধু এই হাত দুটি।
ঘরের ভেতরটা আবছা অন্ধকার, কুলসুমের মুখে পড়েছে উঠানের রোদের আলো। মেয়েটা মাছ কোটে আর কথা কয় আর মাঝে মাঝে একটু ওপরে তাকিয়ে ঘরের অন্য বাসিন্দাটির কথা শোনে, ফের কথা বলে। সেই মানুষটির কী কথা শুনে কুলসুম ফের মাছ কাটায় মন দেয় আর বলে, থাকো। মাছ দিয়া ভাত খায়া যায়ো কেরামত মিয়া কয়টা কানচ মাছ দিয়া গেছে। ফের কী শুনে আফসোস করে, তুমি, তুমি মাছও খাবার পারো না? আহারে, কালাহার বিলের সিখনত থাকো, মাছ মুখোত দিবার পারো না? তুমি খাও তো! পাকুড়গাছ বলে ক্যাটা ফালাছে, মুনসি আর দেখবি কুটি থ্যাকা খাও, কেটা দেখিচ্ছে?
কালাম মাঝির শরীর কাঁপে। লোকটি তবে কে? নিজের ভয় সারাতেই সে মনে করে আমতলির দারোগা আর তহসেনের কথা, নবাবগঞ্জ না নাচোল না ঠাকুরগাঁয়ে পুলিসের প্যাদানি খেয়ে তেভাগার লোকজন সব ছড়িয়ে পড়েছে এদিক ওদিক। তাদেরই কেউ কেউ হয়তো লুকিয়ে রয়েছে বিলের উত্তর সিথানে ঝোপে জঙ্গলে। কিন্তু সেখানে তো মণ্ডলের ইটখোলা। বড়ো গাছ আর কোথায়? তা হলে কি ইটখোলাতেই মিস্ত্রি সেজে লুকিয়ে রয়েছে তারা? এই আসামিকে ধরে আজই কালাম মাঝি যাবে শরাফত মণ্ডলের বাড়ি। তহসেন আসলে ঠিকই বলে, গাঁয়ে দাপট নিয়ে থাকতে হলে মণ্ডলের সঙ্গে বিবাদ না করে বরং খাতির রাখা ভালো। আসামিকে আরো ভালোভাবে সনাক্ত করার জন্যে কালাম মাঝি আরেকটু ধৈর্য ধরে। কিন্তু কুলসুমের মুখে ও! মরার পরে ভাত মাছ গোশতো কিছুই খাওয়া হয় না? খালে গোর আজাব বাড়ে? আজাব হবি আবার খাবার পারবা না? মরা মানুষে মাছ খালে কী দোষ হবি গো? শুনে কালাম মাঝির গা এমনি ছমছম করে ওঠে যে মেঝেতে নিজের পড়ে-যাওয়া ঠেকাতে বেটার বুলি ধার করে তাকে চিৎকার করতে হয়, হ্যান্ডস আপ? তার গলা-ফাটানো হুংকারে দিশাহারা কুলসুম মুখ তুলে সামনে দেখতে পায় কালাম মাঝিকে। তার জবান বন্ধ হয়ে যায়, ছাইমাখা মাছকাটা হাত উঠে আসে বঁটির ওপর থেকে। এমন কি, বয়সে অনেক বড়ো মানুষটাকে দেখে মাথার ওপর কাপড় তোলার কথাও তার খেয়াল থাকে না। আর কালাম মাঝির মুখে পুলিসের ইংরেজি কথা দুটির মানে জানে না বলে নির্দেশটি পালন করাও তার পক্ষে সম্ভব হয় না।
কুলসুমের শেষ কয়টি কথা শোনার পর একটি জ্যান্ত মানুষ দেখতে কালাম মাঝি অস্থির হয়ে উঠেছে, হয়তো এই কারণেই সে ছাড়ে তার দ্বিতীয় হুঙ্কার, মানুষ কুটি? কথা কচ্ছিলু কার সাথে? কুটি?
ঘরের চারদিকে সে দেখে। মাচার ওপর জিনিসপত্র যেভাবে রাখা তাতে আস্ত একটা মানুষ সেখানে লুকিয়ে থাকতে পারে না। এই কাণ্ডজ্ঞানে সমৃদ্ধ কালাম কাঁপাকাঁপা হাতে মাচার ওপরটা কোনোমতে হাত বোলাতে বোলাতে ফের সত্যি সত্যি। কেউ বসে থাকে ওখানে এই ভয়ে ধপাস করে বসে পড়ে মাটিতে এবং কুলসুমের নিশ্বাসের নিরাপদ দূরত্বে বসে হাতড়াতে থাকে মাচার নিচে। সেখানে রাজ্যের জিনিস। তুষের বস্তা, কালাম মাঝির বাড়ি থেকে হাতানো কাচের একটা প্লেট আর একটা বসবার টুল আরো সব হাবিজাবি। মাচার নিচে হামাগুড়ি দিয়েও কালাম মাঝি কোনো মানুষ দেখতে পায় না। মাচার তলা থেকে মাথা বার করে পাছা ঘষটে কুলসুমের আর একটু কাছে বসে মোলায়েম গলায় সে বলে, কুটি গেলো? কথা কচ্ছিলু তুই কার সাথে রে?
কালাম মাঝির তৎপরতা ও কথাবার্তায় কুলসুমের টাকা লাগাটা একটু কাটে, তার চোখে লোকটার চেহারা স্পষ্ট হয়। তার বড়ো বড়ো চোখের পানসে লাল আলোয় কালাম মাঝির স্বর আরেকটু নামে, আরে তোর কী? তুই তো আর ডাকাতির আসামি লোস। খালি ক, তোর ঘরত তুই কার সাথে কথা কচ্ছিলু। মানুষটা পলালো কোনদিক দিয়া?
কুলসুমের হাতে শিঙি মাছের রক্ত শুকিয়ে চটচট করে। কালাম মাঝির আরেকবার তোর ঘরত কেটা রে? প্রশ্নসূচক নির্দেশের জবাবে চোখ তুলে সে চোখের ইশারা করে মাচার পাশের জায়গাটিতে এবং শুকনা গলায় বিড়বিড় করে, তমিজের বাপ।