কুলসুমের দরজার বাইরে একটি মানুষকে দেখে চমকে উঠেছিলো কালাম মাঝিও। তার চমকাবার মধ্যে ছিলো আরেক ধরনের আশা, আশার চেয়েও বেশি বিস্ময় এবং সবচেয়ে বেশি ছিলো খুশি। তা হলে তহসেন আর আমতলির দারোগার সন্দেহই ঠিক?-তমিজ শালা নিয়মিত দেখা করতে আসে কুলসুমের সঙ্গে। রাতে কালাম তার নিজের বাড়িতে কুলসুমের থাকার ব্যবস্থা করায় তমিজ আসতে শুরু করেছে দিনের বেলা? শালা দিনেদুপুরে খুনের ফেরারি আসামি এসে দিব্যি ঘুরে যায় কালাম মাঝির বাড়ির বগল দিয়ে! শালার এতো বড়ো আস্পর্ধা। তমিজটাকে হাতেনাতে ধরতে পারলে গায়ে কালাম মাঝির দাপটটা ফের প্রতিষ্ঠা করা যায়। আর তহসেনের মনটাও ফেরানো যায়। তহসেন আজকাল বাড়িতে আসেই না, এই আজ জিপগাড়ি নিয়ে গোলাবাড়ি পর্যন্ত এসে ওখান থেকেই ফিরে গেলো টাউনে। গিরিরডাঙা পর্যন্ত জিপটা নিয়ে একবার ঘুরে গেলে মাঝিগুলো অন্তত কিছুদিন ঠাণ্ডা হয়ে থাকতো। কিন্তু তহসেনের সঙ্গে কথা। বলাই কালাম মাঝির পক্ষে মুশকিল। হঠাৎ করে সে হয়ে উঠেছে তার সম্মায়ের ভক্তপুত্র। এই সত্যয়ের অত্যাচার থেকে তাকে বাঁচাতে কালাম চোখের পানি মুছতে মুছতে বালক ছেলেটিকে রেখে এসেছিলো তার প্রথম পক্ষের আত্মীয়ের বাড়ি। সেখানে
দিলে তহসেন কি আজ দারাগা হতে পারে? তাই সৎমায়ের ফুসলানি শুনে সে আজকাল বাপের চুলে-দাড়িতে কলপ মাখানো নিয়ে আকারে ইঙ্গিতে যা বলে, তাতে কালাম মাঝির একেকবার ইচ্ছা করে, সমস্ত সম্পত্তি তার লিখে দেবে দ্বিতীয় পক্ষের। মেয়েদের নামে। সেই মেয়েগুলোও আবার মায়ের জন্যে পাগল। শালার ভাগ্নেবৌটাও মনে হয় মামীশাশুড়ির কুটনির কাম করে। নইলে কালাম মাঝি রাতে উঠে যতোবার বুধার ঘরের বারান্দায় যায়, দেখে বুধার বৌ দাড়িয়ে রয়েছে কুলসুমের বিছানা ঘেঁষে। টাউন থেকে পুরো এক টাকা দিয়ে কালাম মাঝি কিনে এনেছে কন্দর্পসঞ্জীবনীর একটা শিশি। কাল রাতে সেটা খুঁজে পাওয়া গেলো না। এসব তার বৌ আর বুধার বৌয়ের শয়তানি। এখন ছেলেটাকে খুশি করতে পারলে এদের আটো করা কালাম মাঝির কাছে ডালভাত। আল্লাই মওকা মিলিয়ে দিলো। তমিজটাকে ধরতে পারলে আমতলির দারোগা থেকে শুরু করে করে টাউনের ছোটো দারোগা তহসেন পর্যন্ত তার বশ থাকে।
শালা ঘাঘু ডাকাত, জেল-খাটা কয়েদি শালা দুপুরবেলা এখানে হাজির হয়েছে। মাথায় বাবরি সাজিয়ে আর ময়লা সবুজ লুঙি আর নিমা পরে। কুলসুমের দরজার পৈঠায় দাড়িয়ে ছিলো বলে কেরামত একটুখানি লম্বা হয়ে যাওয়ায় এই ঝঝ রোদে তাকে ছদ্মবেশী তমিজ বলে ঠাওরানো এমন কি ঘাঘু মানুষ কালাম মাঝির পক্ষেও খুব একটা দোষের ব্যাপার নয়। নিজের পায়ের নতুন পাম্পসুর শব্দ কালাম মাঝির সর্তকতার পরোয়া করে নি। লোকটা তাই পালিয়ে গেলো পলকের মধ্যে। কালাম মঝি বুঝলো, শালা পেছন দিয়ে ঢুকেছে কুলসুমের ঘরে। না-কি পেছনের ভাঙা কাঁঠালগাছে উত্তর দিয়ে উধাও হলো পাকুড়তলার দিকে।
দরজা ঘেঁকে আসে কুলসুমের গলা, তুমি আসিছছা কখন? ওই বাড়িত মেলা কাম লাগিছে গো। আসার ফুরসৎ পাই না। তমিজ ছাড়া আর কারো সঙ্গে কুলসুম এমন কথা। বলতে পারে? কালাম মাঝি শুনতে শুনতে এতোটাই কাপে যে নিজের খুশি কি রাগ কি উত্তেজনার কোনোটাই সে ঠিকমতো ঠাহর করতে পারে না।।
কুলসুম ঘরে ঢুকেই নিজের নিঃশ্বাসের বেগ তীব্র করে গন্ধের উৎস খুঁজছিলো মনোযোগ দিয়ে। নিঃশ্বাসের কয়েকটা টানেই সে বার করে ফেলে তমিজের বাপকে। এক মাথা বালু নিয়ে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে তার মাচা ঘেঁষে। তাকে ওখানে রেখে উঠানের চুলা থেকে ছাই আর তমিজের চাল-ধসা ঘরের এক কোণ থেকে বঁটি আর মাটির মালসা এনে বসে তার নিজের ঘরে। তমিজের বাপ যদি মাচায় বসে এই আশায় এবং সে যদি দরজা খুলে বাইরে চলে যায় এই ভয়ে কুলসুম বঁটি পেতে বসেছিলো দরজায় পিঠ দিয়ে। মটকায় চাপা দেওয়া মাটির সরা তুলে নিতেই শিঙি মাছগুলো ভয়ে কি খুশিতে ওইটুকু পানিতে নানারকম খেল দেখায়। তাদের কোলাহলে মটকা থেকে ছলকে ওঠে আঁশটে সুবাস। মটকার ওপর সরা না থাকায় ফোঁটা ফোঁটা পানির ঝাপটা লাগে। কুলসুমের চোখেমুখে ভারী আরাম!
কালাম মাঝি তার মাছ কোটা কিংবা তার লম্বাটে মুখে আঁশটে পানির ঝাপটা কিছুই দেখতে পায় না, কিন্তু তার কথা শুনতে পায় সবই। কুলসুম জবাব দেয় যেন কার কথার, না গো, ধান ভানার এখনি কী? তার বেটার টাউনের বাসাত চাউল পাঠান লাগবি? আবার তহসেনের মাও কয়, ছুঁড়ি, তুই এ্যানা সর্যা থাকিস। কও তো, হামাক স্যা থাকা লাগবি কিসক? বুড়া হামার মাথা খায়া ফালাবি?
কুলসুমের কথা তো সবই শোনা যায়, কিন্তু তমিজের গলা কোথায়?
কিন্তু কুলসুমের পরের কথাগুলো কালাম মাঝির মাথাটা এলামেলো করে দেয়, তমিজ কুটি গেছে কচ্ছো?-ভালো করা কও। মর্যাও তোমার কথা আবোরের লাকান থ্যাকা গেলো?–খিয়ারেত গৈছে? তোমার বেটার বাপু মাথা খারাপ। মনে নাই? তখন একেবারে চ্যাংড়া মানুষ, খালি দৌড়াচ্ছিলো খিয়ার মুখে। মনে নাই?
কালাম মাঝির বুক ঢিপঢিপ করে, ঘরের ভেতর কুলসুমের সঙ্গী কি তবে তমিজ নয়? তা হলে কে? কেরামত নয় তো? ওই শালা না খিয়ারে চাষাদের জোটের সাথে গান বাঁধতো। এখন আবার তমিজের খবর নিয়ে কুলসুমকে দেয় নাকি? কিন্তু হাটেবাজারে গলা ফাটিয়ে গান করা কেরামতের কথা এখানে শোনা যায় না কেন?