কালাম মাঝি ফেরারি তমিজের সঙ্গে মণ্ডলদের যোগাযোগের কথাটা দারোগার কাছে স্পষ্ট করতে চায়। তমিজকে দিয়ে মাঝিপাড়ায় ঝামেলা করতে চাইছে এই শালার মণ্ডলের গুষ্টি। কিন্তু দারোগা কাদেরের ব্যাপারে কোনো উৎসাহই দেখায় না। কাদেরের অনুমোদন ছাড়া এই বাড়িতে আজ তার আসাই সম্ভব হতো না। দারোগা ফুলজানকে দেখায় অন্যরকম ভয়, তমিজকে না পেলে তোমাদের এই বাড়ি ক্রোক করা হবে, তা জানো?
ফুলজানের ঘ্যাগের ভেতর থেকে ফোস করে ওঠে একটু আগে দেখা গোখরো সাপ, এই বাড়ি কী অর বাপের?
ঠিক কথা। দারোগা একমত হয়েও অন্য যুক্তি দেখায়, তোমার বাপের বাড়ি। কিন্তু তোমার বাপের বাড়ি তো পাবে তোমরা কয় বোন। তোমরা হিস্যা আছে না। এখানে? তোমার সম্পত্তিতে তোমার স্বামীর হিস্যা থাকবে না?
নিজের বিষয় সম্পত্তির মালিকানার বেদখল ঠেকাতে অস্থির হয়ে ওঠে হুরমতুল্লা, মাঝির বেটাক জামাই করা হামার সব্বোনাশ হলো গো দারোগা সাহেব।
ছেলের জুনিয়র সহকর্মীর সামনে কালাম মাঝি উসখুস করে। তাকে উদ্ধার করে। ফুলজান, অর আবার বাড়ির হিস্যা কী? হামি অর ভাত খাই? হামার বিটি হছে, একটা খবর লিছে? উই হামার কিসের সোয়ামি। অর ভাত হামি খামো না।
তালাক দেবে? দারোগার প্রশ্নের জবাব দেয় হুরমতুল্লা, হুঁ। আপনারা তমিজেক ধরেন চাই নাই ধরেন, উই জেলেত থাকুক চাই ঘাটাত ঘাটাত ঘুরুক, হামি হামার বিটির তালাক লিমুই। শরাফত মিয়ার সাথেও হামার কথা হছে, তাইও এই কথাই কছে।
শরাফত মণ্ডলের এরকম প্রতিপত্তি কালামের জন্যে সুখের নয়। বিরক্ত হয়ে সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। দারোগা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, এখানে লাভ হবে না। চলেন,–তমিজের বাড়িতেই চলেন। তহসেন সাহেব প্রথমে তাই যেতে বলেছিলেন।
কালাম মাঝি রাজি হয় না, আরে এখন ওখানে যায়া লাভ নাই। হামার বাড়ির সাথে অর ঘর, হামি জানি না? দারোগা তবু যাবো যাবো করতে থাকলে কালাম বলে, তমিজ আসলেও অনেক রাতে আসবার পারে। যদি যান তো একদিন আঁতকা যাওয়া লাগবি অনেক রাত হলে।
দুপুরবেলার প্রচণ্ড গরমে দারোগার কাছে কালামের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হয়। তবে যাবার তারিখ এখনি সে বলতে পারে না।
ফুলজানের একেকবার মনে হয়, তমিজের ভাত সে খাবে না। যে ভাতার মাসের পর মাস পালিয়েই থাকে, তার জন্যে আবার অন্সে আহ্লাদ কিসের? ভাত না খেলে তার কী হয়? আজই তালাক পায় তো বাপজান কালই তার নিকা দিতে পারে। হুরমতুল্লা : বলে, এবার খাঁটি চাষীর ঘরের ছেলেই জোগাড় করবে।
পুলিস চলে যাবার আগেই আরো ভ্যাপসা হতে লাগলো, গরম একেবারে অসহ্য হয়ে উঠলো। তারপর হঠাৎ করে মেঘ করে বৃষ্টি নামলো ঝমঝম করে। বেশিক্ষণ নয়, সন্ধ্যার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টি থেমে গেলো। আকাশে লেগে রইলো টুকরা টুকরা মেঘ। কাদার মধ্যে বেটিকে কোলে করে ফুলজান বেরোলো ভিটার পেছনে আউশের জমিটা দেখতে। বৃষ্টিতে ভিজে ধানগাছগুলো যেন অনেকদিনের ব্যারাম থেকে সেরে উঠেছে। কিন্তু নষ্ট ফসল কি আর ভালো হয়? ধানের শীষে শীষে রুগ্ন ক্লান্তি, তবু পানির ফোঁটা মাথায় করে তারা যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। আহা! এখনো যদি আউশের খন্দটা ভালো হয়। এই জমিতে প্রথম আউশের আবাদ মার খাওয়ায় হরমতুল্লা রাতদিন তমিজকে বাপমা তুলে গালাগালি করে। ফুলজানের জেদেই আউশ করা হলো, ফুলজানকে তো তমিজই প্রথম বলে, ওই জমিটা আউশের জন্যে ভালো। তা কে জানে, তমিজ থাকলে ওখানে ধান ভালোই হতো হয়তো। মাঝির ঘরের মানুষ হলে কী হয়, তার লাঙল জমিকে ঠিকই বশ করে ফেলতো। অনেকদিন আগে, সে কতো বছর তমিজও জানে না, এই গিরিরডাঙায় নাকি জঙ্গল কেটে জমি তৈরি করেছিলো তমিজেরই পরদাদার পরদাদা, না-কি তারও দাদা। মুনসি তা হলে তমিজের কী?
তাদের ভিটার পেছনে আউশের জমিরও পেছনে আলের ওপরে পায়ের আঙুলে ভর করে দাঁড়ালে বাঙালি নদীর রোগা স্রোতের ওপারে পাকুড়তলায় কিসের আলো দেখা যায়। ওখানে এখন বড়ো কোনো গাছ নাই, ছোেটা ছোটো ঝোপের ওপর সারি সারি আলো জ্বলে আর নেভে। মানুষ ওগুলোকে মুনসির ফেলে-যাওয়া আলো বলে ভয় পায়, আবার খুশিও হয়। ফুলজান এ নিয়ে কখনো কিছু ভাবেও না। অতো রঙ্গ করার সময় কোথায় তার? তবে এখানে দাঁড়ালে খুব গরমের মধ্যেও গা জুড়িয়ে যায়। পাকুড়তলা থেকে কি হাওয়া আসে নাকি? কিন্তু পাকুড়গাছ কোথায়? তার বেটিও ওইদিকেই তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। আকাশে ফের মেঘ জমতে থাকলে ওপারটা আন্ধারে লেপে যায়। গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করলে ফুলজান তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরে বেটিকে বুকের মধ্যে সাপটে ধরে।
৫৬. ভাদ্রের নির্মেঘ দুপুরে
ভাদ্রের নির্মেঘ দুপুরে রোদের তাপ লাগে চড়চড় করে, মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু হলে কী হয়, কুলসুমের সারা শরীর ঘিরে ফুরফুরে হাওয়া চলে তার সঙ্গে সঙ্গে। মানে কুলসুম। যেদিকে যায়, তার সারা শরীরের রোমকুপে আস্তে আস্তে ঢেউ খেলায় ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া। গন্ধটা কেমন চেনা চেনা লাগে, কিন্তু কোথেকে আসছে তা আর ঠাহর করা যায় না। তাকে তাই হাঁটতে হয় অবিরাম বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস টেনে। হালকা হালকা জর্দার গন্ধ মিশে যায় কড়া তামাকের ধোঁয়ায়। তবে এগুলো সবই আসে কিন্তু বিলের আঁশটে-গন্ধ বাতাসে সওয়ার হয়ে।
হাতের বাসন মাটিতে রেখে দরজা খুলতে গেলে পেছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে কুলসুম চমকে উঠলো। এই চমকাবার মধ্যে তার শরীর ঘিরে পাক-দেওয়া গন্ধের উৎস খুঁজে পাবার আশাটিও ছিলো। কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে সে দেখলো, না, সেরকম কিছু নয়। ঘরে ঢুকে সে হুড়কো লাগিয়ে দিলো।