ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে নিজগিরিরডাঙার রাস্তা, কাটা পাট ও পাকা আউশের জমি, এমন কি গাছপালা থেকেও আগুনের ভিজে ভিজে হলকা আসছে। জমিতে মানুষ আউশ কাটছিলো, কোনো কোনো জমি থেকে কাটা পাট নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো খালের দিকে, গরমে কেউ কেউ দম নিচ্ছিলো আমগাছের তলায়। পুলিস দেখে খুরপি, কাস্তে নিয়ে সব ছুটতে শুরু করে। এলোমেলোভাবে দৌড়াতে গিয়ে কেউ কেউ পড়ে যায় পুলিসের একেবারে সামনে।
হুরমতুল্লাহ বসেছিলো তার পুরোনো বর্গী করা জমির আলে কুলগাছের তলায়। পাটের ফলন এবার ভালো নয়, আষাঢ়ে বর্ষণ এবার একেবারেই কম। আল্লার গজব না পড়লে এরকম কখনো হয়? আর ঝড়! জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ—এই তিন মাসে যতোবার বৃষ্টি, ততোবার ঝড়। আজ ভাদ্রের প্রায় শেষ, বৃষ্টি কোথায়? একে গরম, তাতে খন্দের এই হল দেখে হুরমতুল্লার মাথা ঘোরে, কিছুক্ষণ পাট কাটলেই বমি বমি লাগে। সেদিন ছাইহাটার করিম ডাক্তার সাইকেলে এদিক দিয়ে যাবার সময় এক দণ্ড দাঁড়িয়েছিলো, বলে গেলো লেবু আর চিনি দিয়ে সরবত খাবে দিনে অন্তত দুইবার। দুপুরবেলাটায় তার খুব খিদে পায়, তা পান্তার সানকিতে পানিই বেশি, ভাতের দানা মনে হয় গোণা যায়। তার তখন ইচ্ছা করে, খুব ঝাল পুঁটকির ভর্তা দিয়ে দুই সানকি ভাত খায় খুব তারিয়ে তারিয়ে। এখন সুপথ্য চিনি লেবুর সরবত বা কুপথ্য ঝাল পুঁটকির ভর্তা মাখা ভাত কিছুই না জোটায় এবং আবাদ ভালো না হওয়ায় সে বেশ মনমরা। নবিতন ছুটতে ছুটতে এসে হাঁপায় আর বলে, বাপজান পুলিস। বাড়িত পুলিস লাগিছে। মনমরা হুরমতুল্লা নতুন বাছুরের মতো তিড়িং করে উঠে দাঁড়ায় এবং সোজা তাকায় দক্ষিণপূর্বে, সেদিক মণ্ডলবাড়ি। ওই বাড়িটিকেই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা বিবেচনা করে ওদিকে পালাবার জন্যে সে পা বাড়ায়। নবিতন বলে, বাপজান, ঘরত চলো। ঘরত পুলিস।
বাড়ির বাইরে বেঞ্চে বসে রয়েছে আমতলির দারোগা। ঘামে ভিজে গামছায় তাকে হাওয়া করত গেলে হুরমতুল্লা দারোগার ধমক খায়, রাখো তোমার জামাইকে বার করে দাও।
একটু তফাতে কালাম মাঝিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হুরমতুল্লার চোখ মুখ কুঁচকে আসে। এতে তার পুলিসের ভয়টা একটু চাপা পড়ে। এখন তার কুটুম্বিতাকেই যদি কাজে লাগানো যায় এই ভরসায় সে কালাম মাঝিকে তোয়াজ করে, আপনাগোরে বৌ ভালোই আছে। কালাম মাঝি বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয়তাকে কিছুমাত্র আমল না দিয়ে বলে, ভালো তো থাকারই কথা। তোমার জামাই তোমার বেটিক তো টাকাপয়সা, কাপড়চোপড় সবই দিয়া যায়। ক্যাংকা কর্যা দেয়?
দারোগার ইশারায় একজন কনস্টেবল ইউনিয়ন বোর্ডের চৌকিদারকে নিয়ে চলে। যায় বাড়ির পেছনের ভিটায়। ফুলজানের জেদেই এবার সেখানে প্রথম আউশের আবাদ করা হয়েছে। ধানগাছগুলো গরমে ঘামে এবং ধানখেতের তাপে কনেস্টবলের গায়ে ফোস্কা পড়ার জো হলে সে বুট পায়ে খচমচ করে তার মধ্যে হাঁটে।
নবিতন নিজেই এসে কালাম মাঝিকে কদমবুসি করে এবং বলে, আপনে বাড়ির মধ্যে চলেন। কালাম মাঝি তার আরজি কবুল করে এবং দারোগার দিকে তাকালে সেও তাকে ভেতরে যাওয়ার জন্যে ইশারা করে। পেছনে যায় একজন কনস্টেবল।
পুলিসদের খেতে দেওয়ার মতো ঘরে কিছুই নাই। কনস্টেবল বাড়ির ভেতরে এদিক ওদিক আসামী খোজে আর নবিতন ও ফুলজান তাদের আপ্যায়নের জন্যে কী দেওয়া যায় তারই খোঁজে এখানে ওখানে হাতড়ায়। বাপের ঘরের মাচার নিচে হাঁড়িপাতিলে চিড়া মুড়ি খৈ কিছু খাকতে পারে মনে হলে ফুলজান হামাগুড়ি দিয়ে ঢেকে মাচার। তলায়। মাটির একটা হাড়ি ধরে টানতেই ফুলজান চিৎকার করে ওঠে। চিকন কালো একটা সাপ মাথা তুলে তার দিকে ফণা নাচায়। ঘরে লোকজন আসতে না আসতেই দুধভাত না পেয়েও কোনো উৎপাত না করেই সাপ চলে যায় উঠানের দিকে। কালাম মাঝি লাফ দিয়ে ওঠে উঠানের ভেতর এবং কনস্টেবল বলে, আরে এ যে গোখরা সাপ। দারোগা চলে আসে উঠানে, সাপটা তখন রান্না ঘরের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে বাড়ির পেছনের ভিটায়। দারোগা তার ল্যাজ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় নি। তবে পদাধিকারবলে সে রায় দেয়, এই সাপের জোড়া আছে। সাপ তোমরা পোযষা নাকি? সাপের ভয় কাটাতে রাগ করে হুরমতুল্লার ওপর।
এরপর ওই ঘরে দূরের কথা, উঠানেও কেউ যায় না। বাইরে গাবতলায় বেঞ্চে বসে দারোগা বাড়ির লোকজনকে ডেকে জিগ্যাসাবাদ সারে। ফুলজানের মা কোনো জবাবই দিতে পারে না। মাঝখান থেকে মুখের ওপর ঘোমটা বেশি করে টানতে গিয়ে তার শাড়ি পাছার ওপর অনেকটা ফেঁসে যায়।
ফুলজানকে জিগ্যাসা করার সময় যেচে কথা বলে কালাম মাঝি। কালাম মাঝি বলে, তমিজ তোমার কাছে টাকাপয়সা দিয়া যায় কখন? তখন মাঝিপাড়ার মানুষ কেটা কেটা থাকে?
মাঝিপাড়ার মানুষেক এই বাড়িত আসবার দিবি কেটা?
রাগে ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে গেলেও কালাম মাঝি সামান্য একটু ঝাঁঝ মিশিয়ে জিগ্যেস করে, ট্যাকা আর কাপড় দেয় কেটা?।
ফুলজান ফের ফুঁসে উঠতে মুখ তুলছিলো, তার আগেই হুরমতুল্লা তাকে আটকায়, কাদের মিয়া দুইবার ট্যাকা দিছিলো, পুরানা পিরানও দিছে। ধরেন শরাফত মণ্ডল তো হামাগোরে একই বংশের মানুষ। হামার বিটির বিপদ দেখ্যা—
বুড়া, তোমার মরণের আর বাকি কতো? কালাম মাঝি হুরমতুল্লার বয়সের দিকে ইঙ্গিত করে, মিছাকথাগুলা কও কোন মুখে? তোমার আখেরাতের ভয় নাই? কাদের মিয়া ট্যাকা দিলো কুটি থ্যাকা?