এখন তো আর ফেরার জো নাই! ফিরে কাজ নাই!
৫৫. ছাতা বন্ধ করতে করতে
শরাফত মণ্ডল ছাতা বন্ধ করতে করতে কাদেরের দোকানে ঢুকতেই ফুল ইউনিফর্মে মোড়ানো তহসেনউদ্দিন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং একটু উপুড় হয়ে মণ্ডলকে কদমবুসি করে। মণ্ডল হাসি হাসি মুখ করে বলে, থাক, থাক। বেঁচে থাকো। কদমবুসি করলেও আমতলির দারোগাও গ্লামালেকুম বলে পাছাটা চেয়ার থেকে ইঞ্চি দুয়েক উঠিয়ে ফের ঠিকমতো বসে। হাটে এই সাতসকালে পুলিসের জিপগাড়ি দেখে মুগুল খানিকটা আঁচ করেছিলো। কিন্তু তমিজকে খুঁজতে টাউনের পুলিস আসে কোন আইনে?
গফুর মিষ্টির আয়োজন করেছিলো আগেই। খেতে খেতে ছানায় ভেজাল ও মিষ্টির মান নিয়ে নিয়মমাফিক আলোচনায় যোগ দিয়ে শরাফত সরাসরি জিগ্যেস করে, তোমরা তমিজের কোনো হদিস করাবার পারলা না?
আমতলির দারোগার চোখেমুখে একটু অসন্তোষ, ধরা তো যায়ই। কিন্তু বড় মানুষরা যদি আসামিকে শেলটার দেয় তো–।
আরে, বলেন কী? আপনার কাজ আপনি করেন তো, আপনাকে বাধা দেবে কে? কাদের প্রতিবাদ করে এবং আশ্বাসও দেয়, আমি তো আপনাদের এস পি সায়েবকে সেদিন মুখের ওপর বললাম। এইসব চোরডাকাত ছাড়া থাকলে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ শান্তিতে থাকে কী করে?
গ্রিন সিগন্যাল থানাওয়ালারা পেয়েছে সপ্তাহ তিনেক আগে। এর মধ্যে একবার বাড়ি এসে তহসেন তমিজের ঘর ভালো করে দেখেও এসেছে। তবে সে গিয়েছিলো প্লেন ড্রেসে। আমতলির দারোগাকে খোলাখুলি বলেও দিয়েছে, আসামী তো তাদের জাতিগুষ্টির মধ্যেই পড়ে, আবার মণ্ডলরা তাদের পেছনে লেগেই রয়েছে; অফিসিয়ালি তমিজের বাড়ি সার্চ করতে যাওয়াটা তার জন্যে নিরাপদ নয়। আমতলির দারোগা এখন যাচ্ছে নিজগিরিরডাঙায় তমিজের শ্বশুরবাড়ি সার্চ করতে। এলাকার সবচেয়ে বড়ো মুরুব্বির সঙ্গে একটু পরামর্শ করবে। তহসেন এসেছে পরিচয় করিয়ে দিতে। তাকে আবার এক্ষুনি ফিরে যেতে হবে।
তহসেন বলে, হুরমতুল্লা তো আপনার পুরোনো বর্গাদার। আপনি বললে তাকে ধরবে, আপনি না করলে এমনি গিয়ে খুঁজে আসুক।
হুরমতুল্লা মানুষ ভালো। সোজা মানুষ আর কী। তমিজের সাথে বেটিক নিকা দিয়া এখন মুসিবতে পড়িছে। আমি অনেক মানা করিছিলাম। মাঝির বেটার সাথে কুটুম্বিতা–। তহসেনের সামনে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতে সর্তক হয়ে মণ্ডল বলে, জেল-খাটা কয়েদির সাথে আত্মীয়তা করা এখন নিজেই ভুগিচ্ছে। জমি তো মেলা দিছিলাম, বর্গা করিচ্ছিলো। এই বিয়াটা দেওয়ার পরে খালি মোষের দিঘির আশেপাশে কিছু জমি ছাড়া আর সব ফেরত লিছি। ভাবছিলাম সবই ক্যাড়া লেই। পরে দেখলাম, বুড়া মানুষ। আর তোমরা তমিজেক বান্দলে হুরমতুল্লা বেটিক ফির লিকা দিবি অন্য জায়গাত।
তহসেন উৎসাহ পায়। তমিজকে ধরার জেদ তার দিনদিন আরো জোরে সোরে চেপে বসছে। সে নিশ্চিত, ওই ডাকাতটাই মাঝিপাড়ার মানুষদের খেপাচ্ছে। আর ওর সঙ্গে কুলসুমটার একটা যোগাযোগ আছেই। মেয়েটার এমন চমঙ্কার ফিগার, কালো মুখে অস্পষ্ট আলোর আভা, সারা জীবন কাটালো বোকাসোকা অথর্ব বুড়োর সঙ্গে। এখন সতীনের গোয়ার টাইপের কুচ্ছিত ছেলের গায়ের গরম খায়। তহসেন ক্রিমিনাল তো কম চরালো না। ব্রিটিশ আমলের আনডিভাইডেড বেঙ্গল থেকে শুরু করে কয়েকটা ডিস্ট্রিক্টে কতোগুলো থানায় চোরডাকাত ঠেঙিয়ে আসছে সে আজ আট বছরের ওপর। কুলসুমের দিকে তাকিয়েই বোঝা যায়, ওই তাগড়া বডিতে মাগী পারে না হেন কাজ নাই। বডির চেয়েও ডেনজারাস হলো তার নিশ্বাস। এ পর্যন্ত দুইবার সে তার কাছাকাছি গেলো। কুলসুম একবার গন্ধ নিতে শুরু করলে তহসেনের গা শিরশির করে : মাগী বুঝি তহসেনের ব্রেন, হার্ট, ইনটেস্টাইনের ভেতরের সব কিছু কারেক্টলি আইডেনটিফাই করে ফেললো।
একটা প্রবলেম তার বাপকে নিয়ে। কালাম মাঝির বুদ্ধিশুদ্ধি তো কম নাই। এরকম একটা মানুষ,-কুলসুমের জন্যে তার এতো টান কিসের? তাকে কিছুতেই বিশ্বাস করাননা যায় না যে, মাঝিপাড়াকে তমিজ খেপাচ্ছে কুলসুমকে দিয়েই। না। কুলসুমের কোনো দোষ মানুষটা দেখতেই চায় না। কেন? এটা কি কাৎলাহার বিলের সেই জিন না ভূতের সঙ্গে তমিজের বাপের কানেকশনের ভয়ে? কুলসুমের দাদা চেরাগ আলি সেই জিনের খাস বান্দা ছিলো বলেই কি বাপ তার কুলসুমকে ঘটাতে এতে ভয় পায়?
বুদ্ধি পরামর্শ বরং দিতে পারে শরাফত মণ্ডল। হাজার হলেও জমিজমা নিয়েই থাকে, জমির মতোই ধীরস্থির। মাঝিদের মতো মাছের ছটফটানি এদের থাকে না। বড়ো গেরস্থ মানুষ, বুদ্ধি একেবারে পাকা।।
হরমতুল্লার বেটির কথা কবার পারি না। শরাফত বলে, কিন্তু হুরমতুল্লা তমিজেক ঘরত থাকবার দিবি, বিশ্বাস করা কঠিন। তবে তোমার দেখার কথা তো ভালো করাই দেখো।
না। দেখবেন তো ইনি। তহসেন আমতলির দারোগাকে দেখিয়ে দেয়, এলাকাটা তো আমার জুরিসডিকশনে নয়। আমি এখন ফিরে যাচ্ছি টাউনে। তেভাগার কিছু নেতা ধরা পড়েছে, আজ কোর্টে ওঠানো হবে। তো, ইনি হাজার হলেও নতুন মানুষ, আবার বাড়িও এদিকে নয়, পাবনার মানুষ। তা সার্চের সময় এলাকার একজন গণ্যমান্য লোক থাকা দরকার।
সেই গণ্যমান্য লোকটি হওয়ার ভয়ে শরাফত মণ্ডল কাতর হলে তহসেন তাকে বাঁচায়, আমার বাবাকে বলেছি। তো বাবা বোধহয় একবারে হুরমতুল্লার বাড়িতেই চলে যাবেন।
জিপ নিয়ে তহসেন টাউনে চলে যাবার পরপরই আমতলির দারোগা দুইজন কনস্টেবল নিয়ে রওয়ানা হলো নিজগিরিরডাঙার দিকে।