টাসকা মারা গেলা ক্যা গো ওঠো না কিসক? তমিজের এই ধমকে ১৪ অক্ষরের পয়ারের আভাস থাকলেও তমিজের বাপের কানে তা এমনি কষে ধাক্কা দেয় যে চোখের পলকে তার চোখের সমুখের পান্টি মিশে যায় তমিজের হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত, গলার শেকল ঢুকে পড়ে তমিজের কণ্ঠার হাড়ে এবং মাথার কালো পাগড়ি লুকায় তার ঝাঁকড়া চুলের ভেতর। তমিজের বাপ মাচায় উঠে বসে বলে, ক্যা বাবা, সোমাচার ভালো? ছেলের ধমক খাবার ঝুঁকি এড়াতে ছেলের কুশল না জেনেই নিজের চোখমুখদাড়ি দুই হাতে ঘষতে ঘষতে তমিজের বাপ জরুরি তথ্য দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, বুলুর খবর শুনিছিস? কও তো বাপু, তাজা মানুষটা, বেনবেলা প্যাট ভরা পান্তা খায়া বার হছে, পান্তা খাছে, পান্তার সাথে।
শুনিছি। এক কথায় তমিজ তাকে থামিয়ে দিলে আরো কথা বলার খাটনি থেকে রেহাই পেয়ে এবং বুলুর শেষ খোরাক গেলার মুখরোচক বর্ণনা বয়ান করা থেকে বঞ্চিত। হয়ে এখন কী করবে ঠিক বুঝতে না পেরে তমিজের বাপ হঠাৎ করেই মেঝেতে নামে এবং বেলা কুটি গেছে গো বলে ডোবার দিকে যেতে যেতে আপন মনে বলে, আজ শমশেরের জমিত মাঙুন কামলা দেওয়ার কথা। আজ বুধবার লয়?
লিজেগোরে নাই এক চিমটি জমি, হামাগোরে আবার মান কামলা খাটা কিসক গো? তমিজের এই কথার জবাব না দিয়ে তার বাপ বাইরে গেলে তমিজ জোরে জোরে বলে, যার জমিত মাঙুন খাটবা, তাই তোমার খ্যাটা দিবার পারবি? তোমার জমি কোটে? তমিজের এই খেদোক্তির প্রতিবাদ করা মুশকিল। জমিতে মাঙুন খাটা মানে পরস্পরকে মাগনা সাহায্য করা, তমিজের বাপ জমির কাজে সাহায্য করার সুযোগ কোথায়?
তমিজের বাপ বাইরে মুখ ধুতে গেলে তমিজ যায় ভেতরের দিকের নতুন ঘরটিতে। ফাল্গুনে খিয়ার থেকে টাকা এনে এই ঘরটা সে তুলেছিলো নিজের থাকার জন্যে। সে বাইরে গেলে বৃষ্টি বাদলায় কুলসুম এখানে রাঁধে, ধানের বস্তা রাখে। মুরগিটাকে ওমে বসিয়েছিলো এখানেই, বাচ্চাগুলো মরতে মরতে এখন দুটিতে এসে ঠেকেছে, রাতে মুরগিটা দুটি সন্তানকে নিয়ে এখানেই থাকে। আজ মেঘ নাই, তার। ওপর তমিজও বাড়ি এসেছে। কুলসুম তাই উঠানের চুলায় ভাত চড়াবার জন্যে চাল ধুচ্ছিলো। একটা চটের ঝোলা তার হাতে এগিয়ে দেয় তমিজ, গোলাবাড়ি থাকা কয়টা মাছ লিয়া আসিছি। কুলসুম তার দিকে না তাকিয়ে ঝোলাটা নিয়ে চাল ধোয়া অব্যাহত রাখলে তমিজ হঠাৎ নতুন করে গলা চড়ায়, কালাম ভায়েক কয়া গেলাম, তাই বাঁশ দিবি, খ্যাড় দিবি, চুলার উপরে চালা তুল্যা লিবার কলাম। কিছুই তো করো নাই দেখিচ্ছি।
গতবার তমিজ এসে কালাম মাঝির পাতকুয়ার পাট বদলে দেওয়ার কাম করলো, মজুরি নেয় নি। কথা হয়েছিলো ধান দেবে আধ মণ। তমিজের ঘরেই তখন মেলা ধান, কালামের কাছ থেকে ধান এনে দেওয়া মানে আরো কয়েক দিন বাপটাকে বসে খাওয়ার সুযোগ দেওয়া। তমিজ তাই কালামকে দুটা বাঁশ আর কিছু খড় দিতে বলে যায়, ওই দিয়ে তমিজের বাপ উঠানে একটা চালা করে দিলে কুলসুমেরই সুবিধা হয়। চড়া রোদে কুলসুম ভাত রাঁধে, বৃষ্টি নামলে ছোটাছুটি করে ঘরে উঠে তোলা-উনান ধরায়। এসব কষ্ট থেকে তাকে রেহাই দিতেই চালাটা তোলার কথা। তা তাড়াতাড়ি করে তাকে খিয়ারের দিকে যেতে হলো। বাপকে কতোবার বলে গেলো। কোথায় চালা, কোথায় কী? বাঁশের একটা খুঁটি পর্যন্ত নাই। তমিজের মেজাজটা খিচড়ে যায়, ক্যা গো ফকিরের বেটি, হামি না থাকলে একটা কামও কি হবি না গো?
ভোরবেলা বাড়ি এসেই তমিজ গফুর কলুর নিকা-করা বৌয়ের সাথে কথা বলে কুলসুমের দিনটা তো মাটি করে দিয়েছে। সতীনের বেটার এখন শুরু হলো ত্যাড়া ত্যাড়া কথা। কুলসুম কয়েকবার গাল ফুলিয়ে ফুঁ দিলে চুলায় আগুন জ্বলে দপ করে, তার আঁচে মুখটা তার হয়ে ওঠে বেগুনি রঙের। আগুনের তাপে তার গলা বাজে গনগন। করে, হামাক তো তোমরা রাখিছো চাকরানি কর্যা, আবার হামাক দিয়া কামলাও খাটাবার চাও? একবার কথা শুরু করলে কুলসুমের পক্ষে থামাটা কঠিন। তাই তাকে অবিরাম বকে যেতেই হয়, কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ের বাঁশ কি ক্যাটা আনা লাগবি হামাকই? খুঁটি কি হামিই পুঁতমু? রাগে ও চুলার আঁচে তপ্ত বেগুনি মুখটা তমিজের দিকে পলকের জন্যে একবার ঘুরিয়ে ফের চুলায় মনোযোগী হয়ে কুলসুম বলে, হামরা ফকিরের ঘরের বেটি, হামরা কি জেবনে পাকঘর দেখিছি; না-কি পাকঘরত পাকশাক। করিছি? হামাক ওদেত পোড়া লাগবি, বিষ্টিত ভিজা লাগবি। এখন থেকে অন্তত বিকালবেলা পর্যন্ত এই কথাই, একই বাক্য নানা বিন্যাসে সে পুনরাবৃত্তি করে চলবে। কিছুক্ষণের মধ্যে আরো কথা যোগ হবে।-কী? হামার কপালের দোষ। কেন?আগুন ও লোহার পরেই-না, সে ফকিরের বেটি, সে পড়েছে খানদানি মাঝিদের ঘরে। মাঝিদের নিজেদের পাছায় ত্যানা নাই, নিজগিরিরডাঙার হাভাতে চাষারাও এদের সঙ্গে এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করা দূরের কথা, ওঠা বসা পর্যন্ত করে না।—সেই গুষ্টির মানুষ। হয়ে তমিজ কথায় কথায় তাকে খোটা দেয় ফকিরের বেটি বলে। কৈ, তমিজের বাপ তো কুলসুমকে অন্তত বংশ তুলে কখনো কথা শোনায় না। মানুষটা বোকাসোকা আবোর হোক আর পাইঙ্গা হোক, হাজার হলেও কয়েকটা বছর তো চেরাগ আলির পিছে পিছে ঘুরলো। দাদা কি তাকে কিছুই দিয়ে যায় নি। এই যে ঘুমের মধ্যে উঠে সে বাইরে যায়, আবার ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ঠিকঠাক ঘরে ফেরে, এইসব সম্ভব হয় কী করে? তেনাদের কেউ তার ওপর ছাতা ধরে আছে বলেই তো! চেরাগ আলি থাকলে তাকে। সতীনের বেটার এতোই খোটা সহ্য করতে হয়? কুলসুমের দুই চোখের পাতাই ভারি। হয়ে আসে। তবে সাতসকালে ছিনাল মাগী আবিতনের সঙ্গে তমিজের কথাবার্তার। অস্পষ্ট ধ্বনি চুলার আগুনকে উসকে দিলে তার আঁচে চোখ খরখর খরখর করে এবং তার ক্ষোভ বেরিয়ে আসতে থাকে প্রবল তোড়ে। কিন্তু কুলসুমের কথার কি চুলার আগুনের ঝাঁঝ তমিজকে ছুঁতে পারে না, সে কথা বলে চলে তার বাপকে লক্ষ করে। কী,-না, আকালের বছর তার সবেধন নীলমণি তিন বিঘা জমি শরাফত মণ্ডলকে বেচে সে শোধ করলো জগদীশ সাহার দেনা, তার গোরুটা পর্যন্ত নিয়ে গেল জগদীশের মানুষ এসে। তাতেও নাকি সাহার সুদের টাকা সব শোধ হয় নি। সেই মানুষ আবার যায় মান কামলা খাটতে! এরকম হাউস সে করে কোন আক্কেলে? তমিজের বাপ জবাব দেয় না। জবাবের জন্যে পরোয়া না করে তমিজ হাঁটা দিলো রাস্তার দিকে।