তমিজের হাঁকে সেই ঘুম ভাঙলে কুলসুমের বুক কাঁপে : ছোঁড়া এতোদিন বাদে বাড়ি এসেই বাপটাকে বকাঝকা শুরু না করে। দুয়ার ভেতর থেকে বন্ধ, তার মানে তমিজের বাপ সারাটা রাত ঘুম পাড়লো এই মাচার ওপরেই, ঘুমের মধ্যে উঠে সে একবারও বাইরে যায় নি। সারাটা রাত এরকম বেঘোরে ঘুমালো কি বুলুর শোকের তাপে? তা যতোই ঘুমাক, রাতভর বাইরে বাইরে হাঁটার মেহনত যখন হয় নি, তখন কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ঘুম ভাঙবে। বাপ উঠলেই বেটা তাকে বকবে। বাপকে বকায় ব্যস্ত থাকলে তমিজ তাকে বাঁকা বাঁকা কথা শোনাবার ফুরসৎ পাবে না বলে কুলসুম একটু স্বস্তি পায়। আবার বেটার বকাঝকায় তমিজের বাপের কাচুমাচু মুখ ঐ স্বস্তিতে চিড় ধরায়।
এদিকে বাইরে তমিজের গলা শোনা যাচ্ছে ফের, আফাজের বাপের দাফন হলো কোটে? তমিজ নিশ্চয়ই বাইরে কারো সঙ্গে কথা বলছে। এই সুযোগে কুলসুম এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ওপরকার সরা তুলে ফেলে, হাঁড়ির ভেতর থেকে ধোঁয়ার মতো উঠে আসে তমিজের পুরনো পিরানের গন্ধ। বাইরে মেয়েলি গলায় তমিজের কথার জবাব দিচ্ছে কেউ। হাঁড়ি সরাচপা দিয়ে মুখ তুলে কান খাড়া করলে কুলসুম বোঝে তমিজের সঙ্গে কথা বলছে আবিতন। ছি! মাগীর লজ্জাশরম কিছু নাই। মাস ছয়েক আগে গফুর কলুর সঙ্গে নিকা বসলো, তারপর থেকে মাঝিপাড়ায় তার পা দেওয়াই নিষেধ। আজ এতো সাহস সে পায় কোত্থেকে? নিজের বাপের বাড়ি কি মাঝিপাড়া দূরে, থাক, গিরিরডাঙা গ্রাম থেকেই তাকে খারিজ করা হয়েছে চিরকালের জন্যে। গফুর কলুর সঙ্গে মাঝিদের ওঠা-বসা তো দূরের কথা, তার কাছে কেউ কিছু বেচেও না। এমন কি কাদেরের দোকানে কাজ নেওয়ার পর সে অবস্থা অনেকটা ভালো করেছে, কিন্তু মাঝিদের কেউ তার কাছে টাকা হাওলাত নিতেও যায় না। এই অবস্থায় কাদের তাকে দিয়ে লীগের কাজ করায় কী করে? মাঝিপাড়ার মাথাগুলোকে নিয়ে সে কয়েকবার বৈঠক করলো। সে বোঝায়, কলু হোক তেলি হোক, গফুর তো মুসলমান। কী? আবদুল গফুরের ধর্ম কী?-ইসলাম। ইসলামে এসব ভেদাভেদ নাই। মুসলমানের এখন একজোট হওয়া দরকার, একজোট না হলে হিন্দুদের সঙ্গে আর কি। পেরে উঠবো?—তা মাঝিরা আরো বেশি একজোট। গফুর মানুষ হিসাবে যাই হোক, মাঝির বেটিকে বিয়ে করে মাঝিদের সে যেভাবে বেইজ্জত করেছে, তার ও তার বৌয়ের কোনো মাফ নাই। মাঝিদের সিদ্ধান্তে বিরক্ত হয় কাদের, হিন্দুদের মতো জাতপাত মানলে মুসলমান কওম থেকে তোমরা খারিজ হয়া যাও, সেটা বোঝো? ওইসব বৈঠকের একটিতে বুলু নিজেও হাজির ছিলো, এর তিন চার মাস আগে সে বৌকে তালাকও দিয়েছে। আবার কাদেরের সুপারিশেই শরাফতের জমিতে বর্গা করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু সেও মহা গম্ভীর হয়ে চুপচাপ বসে জ্ঞাতিগুষ্টির ক্রোধে ইন্ধন জোগায়। শেষ বৈঠকে শেষ মুহূর্তে কালাম মাঝি এসে একটি কথা বলেই কাদেরকে চুপসে দেয়, আপনার বাপজানের সঙ্গে কথাবার্তা কয়েন। আপনে কি কোনো মাঝির বেটিক বিয়া করবেন? মাঝিগোরে আপনেরা কী চোখে দ্যাখেন, কন তো?
বাড়িতে শরাফত মণ্ডলও ছেলেকে প্রায় একই যুক্তি দেয়, আজ তুমি কলুর সাথে মাঝির বেটির নিকা সাপোর্ট করো, ভালো কথা, কিন্তু কোনো মাঝি তোমার বোনের সাথে সম্বন্ধ করবার আসে তো তুমি রাজি হবা? কাদের জবাব দিয়েছিলো, ছেলে যদি লেখাপড়া জানে তো আপত্তি করবো কেন? সে বলে, লেখাপড়া শিখে চাকরিতে ঢুকেছে বলেই না তার বড়োভাইয়ের এতো খাতির, টমটমে করে গ্রামে ঢোকার সাথে সাথে তাকে দেখতে ভিড় জমে যায় রাস্তার দুই পাশে। আবার মানুষ তাকে হিংসাও করে। এসব তো তার চাকরির জন্যেই। এসব অকাট্য যুক্তি। কিন্তু শরাফত মণ্ডল আবদুল কাদের মিয়া, শোনো, বললে কাদের তার পুরো নাম এবং নামের পর ইজ্জত-বাড়ানো শব্দটি শুনে চোখ নিচে নামিয়ে লতিশুদ্ধ দুই কান পেতে দেয় বাপের। কথা শুনতে, লীগের কামে নামিহো। সামনে ভোট। ভোট চাও তো সমাজ তোমার মানাই লাগবি। মানুষের মন বুঝা কাম করো। বইপুস্তকের কথা থোও। ইগলান কথা কলে ভোট পাওয়া যাবি না। ভোটের কথায় কাজ হয়। গিরিরডাঙা গ্রামে লীগের কাজ থেকে গফুরকে বিরত রাখতেও সে বাধ্য হয়েছে।
যে মাগীকে নিকা করে গফুরের মতো মানুষের হেনস্থার শেষ নাই, সেই আবার তার আগের ভাতার মরতে না মরতে মাঝিপাড়ায় আসার সাহস পায়? ছি! ছি! আবিতনের গলা শুনেই কুলসুম লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলে বাইরে আসে। তাকে দেখেও তমিজ আবিতনকে জিগ্যেস করে, আফাজের বাপের প্যাটের বিষ তো অনেক দিনের, না? জবাব না দিয়েই আবিতন দ্রুত পায়ে চলে যায় গোলাবাড়ির দিকে। কড়া চোখে তার যাওয়া দেখে কুলসুম তমিজকে ঘরত যাও বলতে বলতে ডোবার দিকে রওয়ানা হয়। ঘরে ঢুকে তমিজ বলে, বাজান নিন্দা পাড়ো?
প্রশ্নটি তমিজের বাপের কানে ঢোকে শাসনের মতো এবং সে উঠে বসে ধরফর করে। এ তার চিরকালের ব্যারাম। ঘুম থেকে জাগার সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের মাঝখানে ধক করে আওয়াজ হয় : হায়রে, বেলা বুঝি মণ্ডলবাড়ির শিমুলগাছের বকদের সাদা শরীর বেয়ে নেমে এসেছে গাছের হাঁটু অব্দি, আর এখনো তার চেতন হলো না। এই উদ্বেগ থেকে রেহাই পেতে কিংবা উদ্বেগের ক্লান্তি মোচন করতে সে মেঝেতে থাকলে মাচায় ওঠে এবং মাচায় থাকলে মাচাতেই ফের পাশ ফিরে শোয়। ঘুম অবশ্য তার আর আসে না, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাপসে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে সে হাঁপায়। হাজার হলেও ঘুম হলো তমিজের বাপের এক ধরনের কাজ, তার খুব প্রিয় পেশাও বলা যায়। ঘুমালে তার মেহনত মেলা। ঘুমে ঘুমে তার চলাচল, তার খোঁজাখুঁজি, তার ভাবনাচিন্তা, তার উদ্বেগ ও উত্তেজনা এবং নানারকম বুদ্ধি করা ও ফন্দি আঁটা। সে কী খোজে, ভাবনা তার কী নিয়ে, তার উদ্বেগের কারণ কী, কেনই বা তার এতো উত্তেজনা এসব ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় তার মুশকিল আরো বেশি। তাই ঘুম তার যখনি ভাঙুক অন্তত খানিকটা জিরিয়ে না নিলে তার পক্ষে উঠে দাঁড়ানোটাই কঠিন। কিন্তু এখন সে জিরাবে কি? ঘরের মধ্যে তমিজ। তবে পিঠের নিচে সাপ না বিছার অবিরাম খোঁচায় তমিজের শাসন চাপা পড়ে, ওই শাসন থেকে অব্যাহতির সময়টা আরেকটু বাড়াতেই অদৃশ্য সরীসৃপের ওপর বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং বিড়বিড় করে শালার বেটা শালা বলতে বলতে পিঠের দুর্গম জায়গায় হাত দিয়ে সে বার করে আনে অপরিচিত একটি জীবকে। জীবের দুই পাশে চোখা আগাওয়ালা কয়েকটা ডানা। ডান হাতে চোখের সামনে ধরলে জিনিসটা স্পষ্ট হয় এবং ঝাপসা হয়ে ফুটে ওঠে গত সন্ধ্যার দাফনের ছবি। কাল গোরস্তানের একটি দুই দিনের বাসি কবর থেকে সে এটি তুলে এনেছে। গোরস্তানের খেজুর ডালের গুণ অনেক, এটা সঙ্গে থাকলে রাত্রে কেউ ঘাটাতে সাহস পায় না, এর শক্তি আগুন ও লোহার পরেই। রাতে কাৎলাহার বিলের সিথানে পাকুড়তলায় যাবার সময় এটা সঙ্গে রাখা ভালো। কিন্তু গত রাতটা তার কাটলো শুধু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। অপচয়! অপচয়!-একটি দীর্ঘ রাত্রি বৃথা কাটাবার বেদনায় দমে গিয়েও ঐ রাতটির নষ্ট তেজ ফিরে পাবার লোভে তমিজের বাপ চোখজোড়া বন্ধ করে। এতে কাজও হয় বৈ কি! কালাহার বিলে হাবুড়ুবু খেতে খেতে সাঁতার কাটে ভেড়ার পাল, নিজেদের গজার মাছের সুরত ফিরে পাবার আশায় তারা সাঁতার কাটে খুব মন দিয়ে। এইসব দেখতে দেখতে চোখ মেলে তমিজের বাপ তাকায় ছেলের দিকে। জীবিত একমাত্র সন্তানের কড়া চোখ তার নজরে পড়ে না, ছেলের ঝাঁকড়া চুলে সে দেখে কালো পাগড়ি, তার হাতে লোহার পান্টি, গলায় শেকল।