বুলু মাঝির ভাতারের ভাত-না-খাওয়া বৌ আবিতন এতোক্ষণে চলে গিয়েছে। কতো দূর, কিন্তু গিরিরডাঙার মানুষের ওপর, জলবায়ুর ওপর কুলসুমের রাগ আর যায় না। শাড়ির ময়লা আঁচলে সে মুখটা মুছছে তো মুছছেই। এই মোছামুছিতে নাকের ডগা তার একটু একটু ব্যথা করে এবং ঘষায় ঘষায় ডোবার ঘাসপাতাশ্যাওলা ও গুগোবরমাটির গন্ধ এবং বেলে পুঁটি খলসে শোলের আঁশটে গন্ধ ফিকে হয়ে আসে, ফিকে হতে হতে মিলিয়ে যায়। এই সুযোগে বৈকুণ্ঠের মুখের পানজার সুবাস তার মাথায় ঢুকলে মাথা ঝিমঝিম করে। নেশা-ধরা ঐ গন্ধের সঙ্গতে চেরাগ আলি ফকিরের দোতারার টুংটাং বোল কুলসুমের ডানদিকে বাঁদিকে এবং সামনে ও পেছনে, এমন কি মাথার ওপরেও টক টক মেঘ জমিয়ে তোলে। ওই বাসি গন্ধ ও বাসি আওয়াজেই বৃষ্টি নামে তার গোটা মাথা জুড়ে। বহুদিন আগে এই বৃষ্টির মধ্যেই ছুটতে ছুটতে তারা উঠেছিলো কালাম মাঝির দোকানে। গোলাবাড়ির হাটে সেদিন হাটবার, এর মধ্যে সন্ধেবেলা কী ঝমঝম বৃষ্টি! বৈকুণ্ঠের ডাকে তার দাদা আর দাদার হাত ধরে সে একবার মুকুন্দ সাহার দোকানে, একবার কালাম মাঝির দোকানে ছোটাছুটি করলো। মাথার ওপরে ঝমঝম বৃষ্টি। লক্ষণ তো কোনো দিক থেকেই ভালো ছিলো না। দাদা তার এতো জানে, আর এটুকু কি বুঝতে পারলো না যে, ঐ ঝড় বাদলে আর ঐ অন্ধকার রাতে ঘরের বাইরে থাকার কিংবা নতুন ঘরে ওঠার কোনো ইশারাই নাই? কেন, মাদারিপাড়া থাকতে কোনো কোনো মেঘলা সকালে এমন হয়েছে, ঘরে চাল নাই, মাটিতে উপুড় হয়ে বসে দোতারায় টুংটাং করতে করতে চেরাগ আলি কুলসুমকে পাঠাতে চেয়েছে পড়শির ঘরে, যা তো বুবু, সামাদের মায়ের ঘরত যা, এক টালা চাল চায়া আন। আজ আর বারালাম না। মানুষের মুখঝামটা আর কতো খাওয়া যায়? বৃষ্টির মধ্যেই সে বরং খালের ওপারে চন্দনদহে আকন্দবাড়ির যাবার আবদার ধরলে চেরাগ আলি বলেছে, পানি হলে ঘরত থাকা লাগে রে। পানসে বৃষ্টি তার গলা থেকে ঝরাতো আঠালো গাঢ় স্বর,
আসমানে সাজিল মেঘ হাতির হাওদা।
ঘরেতে বসিল মজনু জপে আল্লা খোদা।
সাগরেদ না বাহিরিও মাস দুই কাল।
পানির বেগানা পথে নসিব কাঙাল।।
তা বাপু আল্লাখোদাই যদি করতো তো চেরাগ আলিকে কি আর দরগার পাকা বারান্দা থেকে ওভাবে উৎখাত হতে হয়? নতুন খাদেম প্রথম থেকেই তার বেদাত কামকাজে অসন্তুষ্ট। এর ওপর সঙ্গে মসজিদ হলো। ওখানে কোনোরকম বেদাত কাম। সহ্য করা হবে না। তা নামাজ বন্দেগি করে পাকা বারান্দায় ঠাঁই পাওয়া গেলে চেরাগ আলি কি তাই করলে ভালো করতো না? কিন্তু মসজিদের ইমাম মেয়েছেলেকে দরগায় থাকতে দেবে না। তবে চেরাগ আলি কি তার নাতনিকে ভাসিয়ে দেবে? চেরাগ আলি অবশ্য বড়ো গলা করে বলতো, শালা ভিন্ন তরিকার মানুষ রে, শালারা হামাগোরে দরগা দখল করিছে। হামার পাও ধরলেও হামি এটি থাকিচ্ছি না। আমরা আজকার ফকির লয়, মাদারি ফকির হামরা, বেড়াকুড়া না খালে দাদা পরদাদারা শাপমন্যি দিবি। এসব গলাবাজি তার ছিলো নতুন খাদেম কিংবা ইমামের আড়ালে, এমন কি দরগার চৌহদ্দির বাইরে, রাস্তায়, যখন কুলসুম ছাড়া তার পাশে আর কেউ নাই। তা খাদেমকে বুড়া যতোই ভয় করুক, ইমামের ভয়ে সে যতোই দরগা ছাড়ুক, এই কথাগুলো বলতে বলতেই তার গলায় গান ফুটতো। তার দোতারার টুংটাং রোল এতোকাল পরেও কুলসুমের মাথায় এতোটাই জোরে বাজে যে মগজের জর্দার নেশা এবং চোখের সামনে তমিজের বাপের চিৎপটাং গতর কোথায় হারিয়ে যায়। মাচা থেকে রান্নার চাল নিতে নিতে তার গলা থেকে বেরিয়ে আসে শোলোক, বেরিয়ে আসে দাদার দোতারার বোলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে।
০৪. ক্যা গো, নিন্দা পাড়ো
ক্যা গো, নিন্দা পাড়ো? ওঠো, ওঠো।
গতকাল শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো, মরার ঘুম আর চোখ ছাড়ে না। বুলু মাঝির ধাক্কায় কুলসুম গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে; এতেই মনে পড়ে, বুলু মাঝি মারা গেছে কাল দুপুরবেলা, তাকে দাফন করে তমিজের বাপ ঘরে ফিরেছে অনেক রাতে। তমিজের বাপ শুয়ে পড়েছে না খেয়েই, মণ্ডলদের বাড়ি থেকে সে খেয়ে এসেছিলো পেট ভরে। শরাফত মণ্ডল বুলুকে মরণোত্তর পুরস্কার দিয়েছে ৮/১০ জন গোরযাত্রীকে পেট ভরে ভাত খাইয়ে। বুলুর নিজের হাতে চাষ করা জমির ধানের ভাত, ভাত কী মিষ্টি! মণ্ডলের চার বিঘা জমি বুলু এবারেই প্রথম বর্গা নিয়েছিলো, জমিতে আউশের ফলন দেখে মণ্ডল খুব খুশি। অথচ প্রথমে এই জমিটা তাকে দিতে মণ্ডল দোনোমনো করছিলো। হাজার হলেও জমির মালিক ছিলো বুলু নিজেই, আড়াই বছর আগে আকালের সময় মণ্ডলকে বেচে দেয়। তা এবার বুলু খুব কারুবারু করলো এবং বিশেষ করে মণ্ডলের ছোটোবেটা তার পক্ষে সুপারিশ করলে মণ্ডল নরম হয়। তা বুলুর হাতে ধান হলোও বটে! হাজার হলেও নিজের জমিই তো ছিলো, ভিটার সাথে লাগোয়া বাপদাদার আমলের জমি তো, বুলুর রোগা শরীরের অমানুষ খাটনিতে জমি কি সাড়া না দিয়ে পারে? হয়তো ঐ জমিতে আউশ ফলাবার জন্যেই আল্লা এই বছরটা হায়াৎ। দিয়েছিলো তাকে, নইলে পেটের ওই ব্যারাম নিয়ে তার চলে যাবার কথা অনেক আগেই। বৌ তো ভেগেছে আরো আগে। শরাফত মণ্ডল গোরযাত্রীদের খাবার সময় কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়িয়েছিলো নিজেই। তার ইশারায় বুলুর বেটা আফাজের পাতে ভাত তুলে দেওয়া হলো কয়েকবার। মাছ সবার জন্যে জুটলো এক টুকরা করে, আফাজের পাতে পড়লো দুটো পেটি। তার লাশ দাফন করে একেকজনের খিদেও পেয়েছিলো খুব, খেয়েও নিয়েছে ঠেসে। বোয়াল মাছের সালুন দিয়ে পেট ভরে খাবার তৃপ্তিতে তমিজেরক্ষ্মাপ কুলসুমের কাছে বুলুর জন্যে শোক ও আফসোসের কথা বয়ান। করে তারিয়ে তারিয়ে। তার বিলাপ ঝাপসা হতে হতে নাক ডাকার একটানা ধ্বনিতে ড়ুব দিলে কুলসুম কী আর করে, মেঝেতে বসে হাঁড়ির ভাত সব খেয়ে নিলো একাই। মাচায় তমিজের বাপের পাশে শুয়ে তার ঘুম আর আসে না। বাইরে বৃষ্টি-বোয়া জ্যো ত্যা, চাঁদের আলো চাল চুয়ে ঢুকে ঘরের অন্ধকারকে অনেকটা পাতলা করে তোলে। এবার বর্ষায় বৃষ্টিতে চালের ছন অনেকটা ক্ষয়ে গেছে। চাল ফুটো হলে বর্ষার পানি তবু হড়িকুড়ি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু শীত ঠেকাবে কী দিয়ে? তমিজ যদি নতুন শাড়ি আনে তার জন্যে তো তার ভেঁড়া শাড়িটা আর তমিজের পুরনো বন আর ন্যাকড়া-ট্যাকড়া জোগাড় করে কুলসুম একটা কথা সেলাই করতে পারে। কাঁথার লাল নীল সবুজ সুতা পাতলা অন্ধকারে তার চোখে শিরশির শিরশির করে। সামনের শীতে নতুন কাথার ওমে ঘুমাবার সুখে তখন কুলসুমের চোখ ভরে ঘুম নামে।