বুড়া এখানে কী মধু যে পেলো তা বুড়াই জানে। এটা কি একটা গ্রাম হলো? প্রথম দিকে দাদার সঙ্গে কোথাও খেতে বসে একটু বেশি ভাত চাইলেই এতোকোনো ছুঁড়ির প্যাটখান কতো বড় গো! কিংবা অদ্যাখলা হুঁড়ি! এবং কারো সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হলেই ফকিরের বেটি, ফকিরের লাতনি,-এইসব কথা শুনতে হয়েছে। ঠিক আছে, দরগায় সুবিধা হলো না, মাদারিপাড়ার সবাই তো চন্দনদহে আকন্দদের জমিতেই মুখ গুঁজে রইলো কয়েকটা মাস, চেরাগ আলি কি সেখানে থাকতে পারতো না? কয়েক মাসের মধ্যে তার জ্ঞাতিগুষ্টি চলে গেলো যমুনার অনেক ভেতরে গোবিন্দপুর চরে, কেউ কেউ ধারাবর্ষায়, কেউ যমুনার পুবপাড়ে মাদারগঞ্জে, সরিষাবাড়িতে। তাদের সাথে সাথে থাকতে পারলেও চাষ করার জমি তো অন্তত কয়েক বছরের জন্যে পাওয়া যায়। যমুনাতীরের মানুষ, যমুনার কোলেকঁখে থাকাই ভালো। কে শোনে কার কথা? চরে যাবার কথা তুললেই চেরাগ আলির ফুটানির কথা, হামরা কি চরুয়া আছিলাম কোনোদিন? বির এলাকার মানুষ চরে যামু কোন দুষ্কে? এসব ছিলো বুড়ার ছলের কথা। আলসের হাড়ি, চাষের কামে কোনোদিন হাত লাগালো না, খালি শোলোক গেয়ে গেয়ে ভিক্ষা করার অছিলা! কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ে ঠাঁই পেয়ে খুশিতে দাদা কয়েকটা দিন বুঁদ হয়ে রইলো। বর্ষাকাল, বৃষ্টি লেগেই থাকে, এরই মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে কয়েকদিন বুড়া খালি পুরোনো শোলোকগুলি ঝালাই করে নিলো। এখানকার কাৎলাহার বিল, তার সিথানে কোন জিন না দেও থাকে, সে কি তার বাপ না সম্বুন্দি কী হয়, চেরাগ আলি তার সারা জীবনের শোলোক মনে হয় বকশা করে দিলো তাকেই।।
কুলসুমের তখন কিছুই ভালো ঠেকে না। এখানে মাঝিপাড়ার মানুষ তেমন খয়রাত দিতে চায় না, মিলাদ পড়ায় কম, ছেলেদের খতনা করে কি-না কে জানে। আর এদের মরা ময়মুরুব্বির পাষাণ হিয়া, ছেলেমেয়েদের খোয়বে এসে দেখাও দেয় না। গোলাবাড়ির হাট বসে সপ্তাহে দুই দিন, জোড়গাছায় এক দিন। এই তিন দিনে ঐসব হাটে গিয়ে দাদায় নাতনিতে প্রাণপণে চাঁচালেও পয়সা যা মেলে তাতে রেজেক হয় কয় দিনের? পেট প্রায় খালিই থাকে। এর ওপর রাতে বাতাস উঠলেই মাথার ওপর বাঁশে বাঁশে ঠোকাঠুকি। মাদারিপাড়ায় যখন ছিলো, রাত্রিবেলা দাদা বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে হাঁটে নি পর্যন্ত। রাত হলেই প্রত্যেকটা বাঁশ হলো তেনাদের একেকজনের আসন। আর এখানে বাঁশঝাড় হলো তেনাদের স্থায়ী ঘরবাড়ি। কিন্তু এসব নিয়ে কিছু বললেই শুরু হতো ফকিরের ভাষণ, এই জায়গার বরকত দেখিছিস? হামাগোরে পরদাদারা এটি অ্যাসা আস্তানা লিছিলো। জ্ঞাতিগুষ্টির কতোজন এটি চোখ মুঞ্জিছে, তানাগোরে রুহ এখনো এটিই ঘোরাঘুরি করে রে বুবু, এই জায়গা যি সি জায়গা লয়।
মাদারিপাড়াত না তোমার দাদা পরদাদা ব্যামাক মানুষের গোর আছে। একোজন মানুষের কব্বর হয় কয় জায়গাত?
হয় না? তাও হয়। চেরাগ আলি নজির দেয়, সেরপুরে এক পীরের দুই মোকাম, দুই মাজার। একটা শিরমোকাম, সেটি গোর দিছে পীর সাহেবের কাল্লাখানা। আরেকটা ধড়মোকাম, সেটি আছে তেনার শরীলটা। দুষমনে পীর সাহেবকে কাটিছে দুই ছাও করা। গোরও হচ্ছে দুই জায়গাত। এক কোশ তফাত।
তোমার পরদাদারা কি সোগলি মরার পর দুই তিনখানা করা ভাগ হছে?
এ রকম নিষ্ঠুর উক্তিতে চেরাগ আলির মন খারাপ করতো, গলা নিচু করে বলতো, আস্তে বুবু, আস্তে। ময়মুরুব্বি সবই শুনিচ্ছে। তবে মন ভালো করার কায়দাও চেরাগ আলির ভালো করেই জানা, সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রয়োগ করে,
সিথানে পাকুড়গাছ মুনসির বসতি।
তলায় গজার মাছ অতি হিংস্রমতি।
এটিকার বিল দেখ্যা, তুমি এই শোলোক নতুন বান্দিছো।
অবোধ বালিকার সন্দেহে চেরাগ আলি হাসে, কোনো শোলোক বাঁধবার ক্ষমতা কি তার আছে? কতো কিসিমের আওয়াজ মানুষের বুকে থাকে। কোনোটা বেরিয়ে আসে কষ্ট পেলে, কোনোটা বেরোয় মানুষ হঠাৎ ভয় পেলে। শোক হলে মানুষের আওয়াজ একরকম, আবার খুশির আওয়াজ আলাদা। এইভাবে কতো শোলোক যে জন্ম থেকে তার বুকে থরে থরে জমা হয়ে আছে, তার দাদা পরদাদার রক্তের সঙ্গে এইসব গান তার শরীরে ভাটি বয়ে এসেছে, কখন সে কোনটা গাইবে তা কি তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে? কুলসুম বোঝে, দাদার কথাই ঠিক, এতো এতো শোলোক দাদা বাঁধবে কী করে? এসব হলো তার পাওনা-শোলোক। শুনতে শুনতে কুলসুমের অনেকগুলো মুখস্থ হয়ে গেছে। রাস্তার মোড়ে, হাটে, বাজারে, মেলায় দোতারা বাজাতে বাজাতে চেরাগ আলি এইগুলো গায়, গাইতে গাইতে চরণের মাঝখানে হঠাৎ তার মুখ বন্ধ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বাকি কথাগুলো সুর করে গাইতে হয় কুলসুমকে। দাদার শোলোক থেকে মাঝে মাঝে পুরনো কথা ঝরে পড়ে, অন্য কোনো শোলোকের চরণ এসে ঢুকে পড়ে সুড়ুত করে, কুলসুম ঠিক ধরে ফেলে। ওদের মাদারিপাড়া দরগাতলায় এসব গান জানে। মেলা মানুষ। এদিকে কখনো কখনো কাউকে কাউকে পাওয়া যায় যারা শোলোকের শুরুতে কয়েকটা চরণ গুণগুণ করে গলা মেলাতে পারে। গোলাবাড়ি হাটের বৈকুণ্ঠ, সেই কেবল কয়েকটা গানের পুরোটাই জানে, আর আর শোলোকের কোনোটা আদ্দেক, কোনোটা সিকিভাগ। গোলাবাড়ি হাটে কালাম মাঝির দোকানে এদের নিয়ে তুললো তো সে-ই। তারই উস্কানিতে কালাম মাঝি তাদের দাদা নাতনিকে নিজের বাঁশঝাড়ে ছাপরা করে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিলো। তখন ছোটো থাকলে কী হবে, কুলসুমের সব স্পষ্ট মনে আছে। এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে হিন্দুটা তার কী সর্বনাশই না করে দিয়েছে। শরাফত মণ্ডলের বেটার সঙ্গে সভা করে করে গফুর কলু যে আজকাল বলে, হিন্দুরা এক জাত, মোসলমান আরেক জাত-কথাটা ঠিকই। না হলে চেরাগ আলি ফকিরের গান শোনার মতলবে বৈকুণ্ঠ কি চিরটা কাল তাদের এখানে রাখার ব্যবস্থা করে কুলসুমের এতো বড়ো সর্বনাশ করতে পারে?