নদীর ভাঙন শুরু হওয়ার আগে মাদারিপাড়া থেকে যমুনার মূলবাড়ি ঘাটে যেতে হাঁটতে হয়েছে এক ক্রোশের ওপর। চেরাগ আলি বলতো তার পরদাদার পরদাদার আমল ওখানে নাকি নদীই ছিলো না, যমুনা ছিলো ছিপছিপে লাজুক একটি খাল মাত্র। গোরা নাসারাদের সঙ্গে লড়াই করার সময় মাদারিরা নাকি যখন তখন ঘোড়ায় চড়েই। এপার ওপার করেছে। শেষকালে গোরারা জিতে গেলে প্রায় পঞ্চাশ ষাট বছর পর এই। গোরস্থান থেকেই মাদারিদের কোন সর্দার ফকির না-কি পীর না পয়গম্বর অভিশাপ দিলে ভূমিকম্প হয়, সাংঘাতিক ভূমিকম্প, তাইতে খালটা পায় নদীর সুরত। কে অভিশাপ দিলো, কী দোষে এই অভিশাপ কিংবা কাকে অভিশাপ দেওয়া হলো-এসব নিয়ে পরিষ্কার করে চেরাগ আলি কখনো বলে নি। কুলসুম জানতে চাইলে গুনগুন করে শোলোক ধরতো,
তানার লানতে মাটি ফাটিয়া চৌচির।
নবস্রোত তালাশিয়া দরিয়া অস্থির।।
সেইমতো ব্রহ্মপুত্র বহে যমুনায়।
করতোয়া হইল ক্ষীণতোয়া শীর্ণকায়।।
আহা রে কুলীন নদী আবিল পঙ্কিলে।
ফকিরে ঠিকানা পায় মহামীন বিলে।।
তা ওই নদীতে-পরিণত খাল পশ্চিম তীর ভাঙতে শুরু করলে চেরাগ আলি হুঙ্কার ছাড়লো, শালী নদী আসুক, মাদারিপাড়ার দিকে আসুক। তখন শালীক দেখা যাবি। নদীর গতি তবু স্তিমিত না হলে সে হুঁশিয়ার করে দেয়, যার অভিশাপে খাল পরিণত হয়েছে নদীতে, তার মুরিদ সাগরেদ, আত্মীয় স্বজন, জ্ঞাতিগুষ্টির কবর আছে না তাদের গোরস্থানে? এই গোরস্থান ডিঙিয়ে নদী এক পা এগোয় তো চেরাগ আলি নিজের নাম পাল্টে এই নাম দেবে কোনো নেড়ি কুত্তাকে। কিন্তু শিরীষ আর পিতরাজ আর শ্যাওড়া গাছের জিন আর ভূত আর কবরে কবরে চেরাগ আলির সব পূর্বপুরুষ আর চেনাজানা আত্মীয়স্বজনের হাড়গোড়শুদ্ধ গোরস্থান গিলে ফেলার পরও যমুনার আয়তন কমে না। চেরাগ আলির নামের মহিমা বরণ করার নেড়িকুত্তাও সব সাফ হলো। তবে হ্যাঁ, নদী এসে থমকে দাঁড়ালো মাদারিপাড়ার ঠিক ধারে এসে। সবাই বোঝে, এতো খাবার পর যমুনা একটু জিরিয়ে নিচ্ছে, গতরটা একটু ঝরঝরে হলেই শালী ফের গিলতে শুরু করবে। তাই মাদারিপাড়ার লোকজন আগেভাগে এদিক-ওদিক সরে পড়তে লাগলো। কিন্তু চেরাগ আলিকে নড়াবে কে? তার ওপর যেন ওহি নাজেল হয়েছে, যমুনার খিদে সম্পূর্ণ মিটে গেছে, আর এক ছটাক মাটি গিললে যমুনা পেটের অসুখেই মারা পড়বে। মাদারিপাড়া হজম করার সাধ্যি শালীর কোনোদিন হবে না। কিন্তু চেরাগ আলির এই জ্যাঠতুতো ভাইয়ের বেটা সামাদ ফকির ভোররাতের স্বপ্নে যমুনার ঘোলা পানিতে নিজের ড়ুবে যাবার স্বপ্ন দেখে তার মাজেজা জানতে এলে চেরাগ আলি ধন্দে পড়ে। ঘোলা পানি দেখা তো ভালো কথা নয়। এ তো রোগের ইশারা বাবা। রোগ বিমারি, বালামুসিবত, এমনকি কারাবাস পর্যন্ত হতে পারে। তবে সামাদ তো ভালো সাঁতার জানে, স্বপ্নেই বা পানিতে কেন ড়ুববে সে? পানিতে ডোবার স্বপ্নের তাবির খুব খারাপ। সামাদের স্বপ্নের তাবির ঠেকাতে চেরাগ আলি যাকে পায় তাকেই ধরে ধরে শোনায়, মাদারিপাড়া গাঁও ছোটো হলে কী হয়, এই গাঁয়ের মাটি বহুত পুরানা। হামাগোরে পরদাদার পরদাদারা দরগাশরিফের ইজ্জত রাখার জন্যে গোরা নাসারা কোম্পানির সাথে নড়াই করিছে। ওই ময়মুরুব্বির দোয়া কায়েম হয়া আছে এই গাঁওত। দোয়ার রকত আছে না? নদী আর সাহস পাবি না, দেখো! পূর্বপুরুষের দোয়া, ভোররাতে ডান কাত হয়ে ঘুমিয়ে তার নিজের দেখা শুভ স্বপ্ন এবং তার সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী নস্যাৎ করে দিয়ে এক বছরেরও কম জিরিয়ে নিয়ে নদী এক বর্ষার মাঝামাঝি ছোবল দিলো মাদারিপাড়ার পুবপাড়া। কয়েকদিনের মধ্যে দক্ষিণ ও উত্তরের মাটি হজম করে পশ্চিম দিক গিলে যমুনা এসে ঠেকলো খালপাড় পর্যন্ত। চেরাগ আলির চাচাতো ভাইয়ের তিন মাসের একটি ছেলে, সামাদ ফকিরের বকনা বাছুরটা, ভুলু ফকিরের সদ্য-ফোঁটা এক পাল হাঁসের বাচ্চা এবং ল্যাংড়া লইমুদ্দির এক ধামা ধান শেষ পর্যন্ত আর বাঁচানো গেলো না। এ ছাড়া আর সবাই থালাবাসন, ঘরের বাঁশের খুঁটি ও বেড়া, বালিশ ও কাঁথা, বদনা প্রভৃতি সম্পত্তি নিয়ে খাল পেরিয়ে খালের পশ্চিম তীরে আকন্দদের জমিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে করতে যমুনার ভোজনের বহরটা দেখলো। একটু দেরিতে তৎপর হওয়ায় বাঁশের ঘরটা চেরাগ আলি রক্ষা করতে পারে নি। কিন্তু তার মাথার কালো টুপি, রঙবেরঙের ছোপলাগা আলখাল্লা, ছড়ি, গলা থেকে বুক পর্যন্ত ঝোলানো লোহার শেকল, দোতারা, কেতাবশুদ্ধ ঝোলা এবং ঝোলার বাইরে কুলসুম-এগুলোর কিছুই। খোয়া যায় নি। এসব নিয়ে কয়েকটা দিন তার কাটলো আকন্দদের জমিতে, হাফেজ দারোগার মায়ের তুলে দেওয়া চালের নিচে। এরপর এক নাগাড়ে মেলা দিন তার কাটে দরগাতলায় দরগা শরিফে। সেখানে নতুন খাদেম জুটেছিলো তখন কয়েকজন, তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এবং দরগাকে পরিণত করেছে মসজিদে। তারা মিলাদ পর্যন্ত করতে দেবে না। মাদারি তরিকার ফকির চেরাগ আলি, এসব শরিয়তি বিধিনিষেধের মধ্যে গেলে তার আর থাকে কী? কুলসুম অবশ্য বোঝে, দাদার ওসব তরিকার জেদ টেদ কিছু নয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, রোজা করা, মওলানাদের ওয়াজ শোনা-এসব করতে গেলে দাদাজানের টোঁ টোঁ ঘোরাটা বন্ধ হয়, তার রোজগারই বা হয় কোত্থেকে? নইলে বর্ষার দিনে ঐ দরগাশরিফের টিনের ছাদের নিচে পাকা বারান্দায় শোবার সুযোগ ছেড়ে দাদা মরতে আসে এই গিরিরডাঙা গ্রামের কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ে পাটখড়িঘেরা ছনের ছাপরায়?