আগরবাতির ধোঁয়ার সঙ্গে গুড়ের গন্ধে দরগাশরিফ সবসময় ম ম করে। ফকিরের বেটি বলে ওখানে কেউ তাকে কখনো হেলা করে নি।–না-কি করেছে? কী জানি?–হেলা যদিও করে থাকে তবু শিরনি পেতে তো অসুবিধা হয় নি।
কষ্টে কাটতো বর্ষাকালটা। বাইরে যাওয়া মুশকিল, আবার ভাদ্র মাসে আউশ কাটার আগে পর্যন্ত মানুষ সহজে ভিক্ষা দিতে চায় না। ঐ সময়টা মানুষ খোয়াবও দেখে না। ধান উঠলে ঐ এলাকার মানুষের খোয়াব দেখার ধুম পড়ে গেছে। খোয়াবে খারাপ কিছু দেখলেই চেরাগ আলির কাছে ছুটে এসেছে মানুষ, ও ফকির, কও তো, পাছারাতে দেখলাম, আমাগোরে কুয়ার পানি ক্যামা গরম ঠেকিছে। বালটি দিয়া তুল্যা গাও থোমা, পিঠোত পানি ঢালিচ্ছি, তামান পিঠ বলে পুড়্যা গেলো গো। এই খাবের মাজেজা কী, কও তো বাপু। ঝোলা থেকে একমাত্র বইটা বার করে চেরাগ আলি আস্তে আস্তে পাতা ওলটাতো। প্রতিটি পৃষ্ঠা ওলটাবার সঙ্গে জিভে আঙুল ছুঁয়ে বলতো, স্বপন তুমি কখন দেখিছো কও তো। ঠিক লগ্নটি বলতে স্বপন-দেখা মানুষটা আমতা আমতা করলে তাকে করা হতো পরবর্তী প্রশ্ন, পাছারাতোত তুমি শুছিলা কোন কাত হয়? পাশে বই রেখে বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই ঘরের সাসনে ছোটো উঠানে কাঠি দিয়ে চৌকো চৌকো দাগ দিতে দিতে সে এরকম প্রশ্ন করেই যেত এবং অন্তত পঁচিশটা প্রশ্ন করে তার অর্ধেকেরও জবাব না পেয়েও স্বপ্নের মাজেজা বলে দিতো। কুয়ার পানি স্বপ্নে গরম হলে তার ভাগ্যে অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত,-এই খবর দিয়ে না হলেও দুটো পয়সা সে কামাতোই। কিন্তু বর্ষা আর কার্তিক অগ্রহায়ণে মানুষের স্বপ্ন দেখা বন্ধ। কার্তিকের। অভাব আর কাটে না। কিন্তু অভাবের সাধ্য কি যে চেরাগ আলিকে কাবু করে? পেটে কিছু পড়ুক আর নাই পড়ুক, তার কথার তেজ যদি এতোটুকু কমে। কার্তিক হয়ে যায় তার কাছে পোয়াতি মাস। কেমন?–
ছাওয়া লে গর্ভেতে ধরি শুকায় পোয়াতি।
মাতার লোহুতে পুত্র বাড়ে দিবারাতি।।
খালি পেটে এসব শুনতে কুলসুমের ভালো লাগতো না, খালি হাবিজাবি কথা কও!
হাবিজাবি লয় রে ছুঁড়ি, বুঝ্যা দ্যাখ। চেরাগ আলি তার শোলোক ব্যাখ্যা করে, মাটি এখন গভভো ধারণ করিছে। তার গভভে দুটা মাস, এক কাত্তিক আর এক। আঘুন। পোয়াতি হলে মেয়ামানুষের শরীল শুকায়, এক প্যাট ছাড়া পোয়াতির ব্যামাক অক্ত তার খায়া ফালায় প্যাটের ছাওয়াল। পৌষ মাসে পোয়াতি বিয়ালে তার কোনো দুষ্ণু থাকে না। বলতে বলতে দাদার মুখ থেকে ব্যাজার ভাব কেটে যায়, কার্তিক মাসের অভাব যে সচ্ছলতার প্রস্তুতি ছাড়া কিছুই নয় এই আশ্বাসে সে মহা খুশি। কিন্তু ঘরে বসে আনন্দ অপচয় করার বান্দা চেরাগ আলি নয়, হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে ঝোলাটা টেনে নিয়ে বলে, চল বুবু, বেড়াকুড়া আসি। একটা বেলার খোরাক তো পামু। বেড়াকুড়া আসা মানে ভিক্ষা করা, মাদারিপাড়ার লোকজন এভাবেই বলতো। ওখানকার কেউ তার এই পেশায় দোষের কিছু দেখেনি। ছোট খাটো বিপদ আপদ, বালা মুসিবত হলে পরামর্শ নিতে কি স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন দেখলে তার তাবির জানতে তারা বরং ফকিরের কাছেই আসতো। কলিকাল,আখেরাতের আর বাকি নাই, পরামর্শ শুনে বেশি পয়সা দেওয়ার মানুষ কমে গেছে, ফকির তাই বেড়াকুড়া খায়। এতে হেলা করার কী আছে?–না-কি ভেতরে ভেতরে সবাই তাদের একটু ছোটো নজরেই দেখেছে? কী জানি?–চেরাগ আলি ওদিকে সবার কাছে ফকিরের বেটা। ফকিরের বেটা চলেছে। আগে আগে, তার মাথায় কালো রঙের কাপড়ের টুপি, আলখেল্লাটির রঙ এককালে হয়তো কালোই ছিলো, পরে নানা রঙের কাপড়ের তালি লাগার ফলে আসল রঙ খুঁজে পাওয়া দায়। কাঁধে রঙ-জ্বলা চটের ঝোলা, এর ভেতরে তার বই। আবার গেরস্তের ঘরের চাল, বাজারে হাটে দোকানদাররা আলু পেঁয়াজ, পটল, বেগুন, মরিচ, সময়ের আমটা কলাটা যে যা দেয় নেওয়ার জন্যে সে এটা সামনে এগিয়ে দেয়। পয়সা নেওয়ার জন্যে কুলসুমের হাতে একটা টিনের থালা। ফকির হাটে তড়বড় করে। সরু দুটো পা যেন দুটো রণপা। হাতের ছড়িটাকে কখনো কখনো ভুল হতো চেরাগ আলির আরেকটি পা বলে। দাদার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কুলসুমের জোরে হাঁটার অভ্যাস হয়েছে, এখন চেষ্টা করেও পায়ের গতি সামলাতে পারে না। তা মাদারিপাড়ায় থাকতে কুলসুমের হাঁটার দোষ কেউ ধরে নি।—ধরতো কি? কী জানি?—এখানে আসার পর, বিশেষ করে তমিজের বাপের সংসার করতে শুরু করার পর থেকে মাঝিপাড়ার বৌঝিরা তার যেসব। খুঁত ধরে বেড়ায় তারই কোনো কোনোটি সে গুলিয়ে ফেলে মাদারিপাড়ার মানুষের কথাবার্তার সঙ্গে। আবার এমনও হতে পারে, মাদারিপাড়ায় থাকতে দাদার বেড়াকুড়ার সাথী হয়ে এ-গাঁও ও-গাঁও ঘুরতে ঘুরতে মানুষের যেসব খোটা শুনেছে তাই সে আরোপ করে বসে গিরিরডাঙা আর নিজিগিরিরডাঙার বৌঝিদের মুখে। মাদারিপাড়ার কি আর সব ভালো? ওই গায়ে কারো অবস্থাই ভালো লয় গো! ওখানে বারো মাসই আকাল, বারো মাস টানাটানি। একটা দিন খাল পেরিয়ে না ঘুরলে ওখানে ভাত জোটে নি। ছোটো গাম, ঘর মোটে কয়েকটা, সবাই ফকিরের জ্ঞাতিগুষ্টি। পুবদিকে এক ক্রোশ চাষের জমির পর যমুনা, এর মধ্যে কয়েক বিঘা বাদ দিলে সবটাই চন্দনদহের আকন্দদের, শিমুলতলার তালুকদারদের, রৌহাদহের খাদের আর গোঁসাইবাড়ির মণ্ডলদের জমি। মাদারিপাড়ার ফকিরদের বেশিরভাগ মানুষ ওখানে বর্গা করে নয়তো কামলা খাটে। কয়েক বিঘা পতিত জমির মালিক ছিলো ফকিররা, তাই নিয়ে তাদের দেমাক কতো! অতো দেমাকের কী আছে? যেখানে পুরনো আমলের গোরস্থান। একটা মস্ত শিরীষ গাছ, কয়েকটা পিতরাজের গাছ আর দুটো শ্যাওড়া গাছ। জিন আর ভূতের আস্তানা। ফকিরগুষ্টির কেউ মরলে গোর দেওয়া হতো ওখানেই; কিন্তু দাফন সেরেই জ্যান্ত মানুষগুলো তড়িঘড়ি করে ঘরে ফিরতো। পরে গোর জিয়ারত করতে যাবার সাহসও কারো হয় নি। এখন তো ওসবের চিহ্নমাত্র নাই।