- বইয়ের নামঃ খোয়াবনামা (উপন্যাস)
- লেখকের নামঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃউপন্যাস
০১. পায়ের তলা কাদা
পায়ের পাতা কাদায় একটুখানি গেঁথে যেখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলার রগ টানটান করে যতোটা পারে উঁচুতে তাকিয়ে গাঢ় ছাই রঙের মেঘ তাড়াতে তমিজের বাপ কালো কুচকুচে হাত দুটো নাড়ছিলো, ঐ জায়গাটা ভালো করে খেয়াল করা দরকার। অনেকদিন আগে, তখন তমিজের বাপ তো তমিজের বাপ, তার বাপেরও জন্ম হয় নি, তার দাদা বাঘাড় মাঝিরই তখনো দুনিয়ায় আসতে ঢের দেরি, বাঘাড় মাঝির দাদার বাপ না-কি দাদারই জন্ম হয়েছে কি হয় নি, হলেও বন-কেটে বসত-করা বাড়ির নতুন মাটি ফেলা ভিটায় কেবল হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে, ঐসব দিনের এক বিকালবেলা মজনু শাহের বেশুমার ফকিরের সঙ্গে মহাস্থান কেল্লায় যাবার জন্যে করতোয়ার দিকে ছোটার সময় মুনসি বয়তুল্লা শাহ গোরা সেপাইদের সর্দার টেলরের বন্দুকের গুলিতে মরে পড়ে গিয়েছিলো ঘোড়া থেকে। বন্দুকের গুলিতে ফুটো গলা তার আর পুরট হলো না। মরার পর সেই গলায় জড়ানো শেকল আর ছাইভস্মমাখা গতর নিয়ে মাছের নকশা আঁকা লোহার পান্টি হাতে সে উঠে বসলো কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়গাছের মাথায়। সেই তখন থেকে দিনের বেলা রোদের মধ্যে রোদ হয়ে সে ছড়িয়ে থাকে সারাটা বিল জুড়ে। আর রাতভর বিল শাসন করে ওই পাকুড়গাছের ওপর থেকেই। তাকে যদি এক নজর দেখা যায়–এই আশায় তমিজের বাপ হাত নাড়াতে নাড়াতে আসমানের মেঘ খেদায়।
তা না হয় হলো, কিন্তু এখন থেকে দুই বছর সোয়া দুই বছর পর, না-কি আড়াই তিন বচ্ছরই হবে, বিলের পানি মুছতে মুছতে জেগে-ওঠা ডাঙার এক কোণে চোরাবালিতে ড়ুবে মরলে তমিজের বাপটা উঠবে কোথায়? তাকে ঠাঁই দেবে কে? বড়ো বানের ছোবলে বড়ো বড়ো কঁঠালগাছ তো সব সাফ হয়ে গেছে মেলা আগে, শরাফত মণ্ডলের বেটা ইটখোলা করলে বাকি গাছগুলোও সব যাবে ভাটার পেটে। তখন? তখন তমিজের বাপ উঠবে। কোথায়? দিনে দিনে বিল শুকায়, শুকনা জমিতে চাষবাস হয়, জমির ধার ঘেঁষে মানুষ ঘর তোলে। বড়ো বিরিক্ষিকে জায়গা দেওয়ার মতো জায়গা তখন কি আর পাওয়া যাবে?
দিনের বেলা হলে ভালো করে দেখা যায়,-বিলের পশ্চিমে বিলের তীর থেকে। এদিকে খালপাড় পর্যন্ত জায়গাটা এখন পর্যন্ত খালিই পড়ে রয়েছে। তারপরই মাঝিপাড়া। মাঝিপাড়ার মানুষ অবশ্য নিজেদের গ্রামকে ওভাবে ডাকে না, গোটা গ্রাম জুড়ে তো আগে তাদেরই বসবাস ছলো। এখন পাঁচ আনা ছয় আনা বাসিন্দাই চাষা। আগে কয়েক ঘর কলু ছিলো, আট মাইল পশ্চিমে টাউনে তবিবর মুক্তারের রহমান অয়েল মিল হওয়ার তিন বছরের মধ্যে কলুদের অর্ধেকের বেশি চলে গেলো পুবে যমুনার ধারে। যে কয় ঘর আছে তাদের কারো কারো ঝোঁক জমিতে আবাদ করার দিকেই বেশি।
বিলের ওপারে অনেকটা জমি জুড়ে চাষবাস, তারপর ছোটো খালটা পার হলে চাষাদের গ্রাম। সেখানে একেকটা ঘরের পাশে বাঁধা গোরু, বৃষ্টির পানিতে ভিজে কালচে হয়ে-যাওয়া হলদে খড়ের ভাঙাচোরা গাদা, ভেরেণ্ডা ঝোপের পাশে গোবরের সার, কলাগাছের ঝাড়, বৌঝিদের আব্রু করতে শুকনা কলাপাতার পর্দা, ঘরের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা লাঙল, মই ও জোয়াল। সকাল থেকে দুপুর, এমন কি আষাঢ়ের বিকালে বৃষ্টি না হলে সন্ধ্যাবেলাতেও এপারে দাঁড়িয়ে ওপারটা স্পষ্ট দেখা যায়। শরাফত মণ্ডলের হাতে খাজনা দিয়ে দূৰদূরান্তের জেলেরা এসে মাছ ধরে। ওপারের চাষারা, চাষাদের বৌঝিরা পর্যন্ত সার করে দাঁড়িয়ে তাই দেখে। সেসব দিনে বিলে হুলুস্থুল কাণ্ড। জেলে আর কয়জন? সংখ্যায় তাদের তিন গুণ চার গুণ বেশি চ্যাংড়াপ্যাংড়া বিলের তীরে লাফাতে লাফাতে হৈ চৈ করে। তখন কি বিল কি জমি, কি পানি কি ডাঙা কারো কোনো আব্রু নাই। তখন মানুষ বলো, গোরুবাছুর বলো, মেয়েমানুষ বলো আর ছোলপোল বলো, মাছবলো শামুক বলো, সব, সব শালা উলঙ্গবাহার হয়ে বেহায়ার। মতো খ্যামটা নাচন নাচে।
এখন রাত। এখন কিন্তু অমন নয়। সন্ধ্যা থেকে আবছা কালো পাতলা একটা জাল পড়ে বিলের ওপর, সন্ধ্যা গড়ায় রাত্রিতে আর ঐ অদৃশ্য জালের বিস্তার বাড়ে ঐ সঙ্গে। অন্ধকার গাঢ় হতে হতে সেই বেড় জালের নিচে ধরা পড়ে সমস্ত এলাকা। রাত বাড়ে, রাত আরো বাড়ে, কেউ টের পাবার আগেই শুরু হয় জাল গোটানো। পাকুড়গাছ থেকে টান পড়ে জালের দড়িতে, আস্তে আস্তে দুই পাড়ের গ্রাম নিয়ে গোটা বিল তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে এসে থিতু হয় বিলের মাঝখানে। পূর্ণিমা, অমাবস্যা, একাদশী-কী শুক্লপক্ষ কী কৃষ্ণপক্ষ-গিরিরডাঙা-নিজগিরিরডাঙা-কাৎলাহার বিলের দুই পাড়ের দুই গ্রাম এই বিলের মধ্যে একাকার হয়ে যায়। তখন যাই দেখো, একটার থেকে আরেকটার ফারাক ধরতে পারবে না। তখন বিলের সিথান থেকে সেই পাকুড়পাছ মস্ত ছায়া ফেলে বিলের ওপর। রাত বাড়ে, বিলু জুড়ে তার ছায়া খালি ছড়াতে থাকে, ছড়াতেই থাকে। অমাবস্যার ঘনঘোট অন্ধকার কি পূর্ণিমার হলদে জ্যোৎস্না কিংবা কৃষ্ণপক্ষের ঘোলা লাল আলোয় সেই মস্ত ছায়া গতরে মুড়ে কাৎলাহার বিল, বিলের দুই পাশে গ্রাম, বিলের কাছে খাল, বিলের সিথানে পাকুড়তলা, ওদিকে দক্ষিণে শরাফত মণ্ডলের টিনের বাড়ি এবং বাড়ির পুবে সাদা বকে-ছাওয়া শিমুল গাছ-সব, সবই মায়ের কাছে ভাতের জন্যে কাঁদতে কাঁদতে গায়ে মাথায় জাল জড়িয়ে ঘুমিয়ে-পড়া মাঝিপাড়ার বালকের মতো একটানা নিশ্বাস নেয়। সেই নিশ্বাসের টানে ফেঁপানির রেশ। সব একসঙ্গে দেখার তখন ভারী জুত। এই সময় বেড়জালের দড়ি টানতে টানতে বিলের মাঝখানের আসমানে এসে দাঁড়ায় মুনসি বয়তুল্লা শাহ। তার আগে সাঁতার কেটে কেটে চলে যায় ভেড়ার পাল। মুনসিকে এক নজর দেখার সুযোগটা নিতেই তমিজের বাপের এখানে আসা। মুনসি কখনোই বেশিক্ষণ থাকে না। ওপরে আসমান আর নিচে পানি ও জমিন একেবারে একাকার। সবখানে মুনসির ইচ্ছামতোন বিচরণ। সবাইকে একটি লহমার জন্যে এক জায়গায় ঠাঁই করে দিয়ে জাল নিয়ে সে উড়াল দেবে উত্তরের দিকে। বাঙালি নদীর পথভোলা রোগা একটি স্রোত এসে মিশেছে। সেখানে কাৎলাহার বিলে। বিলের শিওরে পাকুড়গাছে বসে সকাল থেকে শকুনের চোখে মণি হয়ে ঢুকে মুনসি সূর্যের আকাশ পাড়ি দেওয়া দেখবে, দেখতে দেখতে হঠাৎ রোদে মিশে গিয়ে রোদের সঙ্গে রোদ হয়ে ওম দেবে বিলের গজার আর শোল আর রুই আর কাৎলা আর পাবদা আর ট্যাংরা খলসে আর পুঁটির হিম শরীরে। আর হয়রান হয়ে পড়লে পাকুড়গাছের ঘন পাতার আড়ালে কোনো হরিয়াল পাখির ডানার নিচে ছোটো একটি লোম হয়ে নরম মাংসের ওমে টানা ঘুম দেবে সারাটা বিকাল ধরে।