সুপ্তি রান্নাঘরে ঢুকল। আনন্দিত গলায় বলল, মা তোমার কোন সাহায্য লাগবে?
সুরমা বললেন, না।
পরে কিন্তু ডাকাডাকি করতে পারবে না।
তুই করছিস কী? গল্প?
উহুঁ। আমি উনাকে ম্যাজিক শেখাচ্ছি মা। দড়ি কাটার ম্যাজিক!
কী বলছিস তুই। ম্যাজিশিয়ান ছেলে তাকে তুই কী ম্যাজিক শিখাবি?
উনি ম্যাজিক-টেজিক তেমন জানে না মা।
তাহলে যা। ম্যাজিক শিখিয়ে দে।
.
সেই রাতে সুপ্তি অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল। যেন সে হাঁটতে হাঁটতে গভীর বনে ঢুকে গেছে। সেই বনের গাছগুলি অদ্ভুত। ডালের মাথা প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। গাছ ভর্তি ফুল। ছোট ছোট সাদা ফুল। আশ্চর্য কাণ্ড ফুলগুলি দেখতে বেলী ফুলের মতো। বেলী ফুলের তো এত বড় গাছ হয় না। বেলী ফুলগাছ লতানো ধরনের হয়। এত বড় গাছে বেলী ফুল ফুটেছে তার মানে কী! ফুলগুলির কী সুন্দর গন্ধ। স্বপ্নের মধ্যেই সুপ্তি গন্ধ পেল। এবং সে এতই অবাক হল যে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আশ্চর্য ব্যাপার ঘুম ভাঙ্গার পরেও স্বপ্নের গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার সারা বিছানায় কেউ যেন বেলী ফুল বিছিয়ে রেখেছে। এটা কেমন স্বপ্ন যে স্বপ্ন ভাঙ্গার পরেও স্বপ্নের ছায়া থেকে যায়। এই স্বপ্নের সঙ্গে কি ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার কোন সম্পর্ক আছে? না, তা কী-করে থাকবে। সুপ্তি ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন তার আর স্বপ্নের কথা মনে রইল না।
কালো যাদুকর মবিন উদ্দিনের বাড়িতে
পনেরো দিন হল কালো যাদুকর মবিন উদ্দিনের বাড়িতে আছে। এক বুধবার এসেছিল, মাঝখানে এক বুধবার গিয়েছে, আজ আরেক বুধবার। এর মধ্যে তার নাম বদল হয়েছে। তাকে ডাকা হয় বাবলু নামে। সুরমা অবশ্যি মাঝে মাঝে ভুল করে টুনু ডেকে ফেলেন। সে বসার ঘরে থাকে। বসার ঘরে একটা সিঙ্গেল খাট আছে। খাটে ঘুমোয়। বাকি সময়টা খাটে বসেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রথম কয়েকদিন বসার ঘরেই তাকে খাবার দেয়া হত। এখন সুরমা ভাত খাবার সময় তাকে ভেতরে ডেকে নেন। ছেলেটার সঙ্গে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেন। সে বেশির ভাগ সময়ই হ্যাঁ না করে উত্তর দেয়। কথা বলার সময় চোখের দিকে চোখ তুলে তাকায় না। সুরমা অনেক চেস্টা করেও তার কাছ থেকে তেমন কিছু জানতে পারেননি। অতি সাধারণ প্রশ্নের উত্তরেও সে এমন সব কথা বলে যার কোন অর্থ হয় না। যেমন সেদিন জিজ্ঞেস করলেন, তোমার দেশ কোথায়? সে ভাত ডাল দিয়ে মাখতে মাখতে তার দিকে তাকিয়ে হাসল, উত্তর দিল না। তিনি আবার বললেন, তোমার দেশ কোথায়? গ্রামের বাড়ি?
সে চোখ না তুলেই বলল, নাম মনে নেই।
নাম মনে নেই তার মানে কী? নাম ভুলে গেছ?
হুঁ।
কোন জেলা সেটা মনে আছে?
জ্বি না।
নেত্রকোনা থেকে জায়গটা কত দূরে?
দূরে।
সুরমা বললেন, দূরে তো বুঝলাম। কত দূরে?
অনেক দূরে।
অনেক দূরেরও তো একটা হিসাব আছে। সেই হিসাবে বল কত মাইল দূরে?
জানি না।
জানি না কেমন কথা?
বাবলু তার উত্তরে এমন ভাবে হাসছে যেন সুরমা অত্যন্তু বোকার মতো একটা প্রশ্ন করেছেন। এই প্রশ্নের জবাব দেবার দরকার নেই। সুরমার মনে নানান রকম সন্দেহ হয়, যেমন ছেলেটা পাগল নাতো? ভদ্র পাগল। হৈ চৈ করে না। চুপচাপ বসে থাকে। অনেক রকম পাগলই তো সংসারে থাকে এও এক ধরনের পাগল। পাগল হোক ছাগল হোক ছেলেটার উপর তাঁর মায়া পড়ে গেছে। মায়া পড়ার প্রধান কারণ হলো ছেলেটা দেখতে অবিকল তার মৃত ছেলের মতো। দ্বিতীয় কারণ, ছেলেটা অতি ভদ্র। আজকালকার ছেলেরা এত ভদ্র হয় না, বেয়াড়া ধরনের হয়। এ বেয়াড়া নয়। লাজুক এবং মুখচোরা। এরকম মুখচোরা লাজুক স্বভাবের ছেলে ম্যাজিক দেখায় কী করে সে এক রহস্য।
ম্যাজিকের ব্যাপারে সুরমার তেমন উৎসাহ নেই। ম্যাজিক হচ্ছে ছেলে ছোকরার বিষয়। ছেলেটার ম্যাজিক একবারই তিনি দেখেছেন। তাঁর কাছে এমন কিছু আহামরি মনে হয়নি। সে একটা কাগজ টেবিলের উপর রেখেছে। দেখতে দেখতে কাগজটায় আপনা আপনি আগুন ধরে গেল। চোখের সামনে পুড়ে ছাই। এটা এমন কোন ম্যাজিক না। কাগজে গোপনে কিছু দিয়ে রেখেছিল—এ্যাসিড ফ্যাসিড জাতীয় কিছু। ভাল ম্যাজিক, তবে এরচে ভাল ম্যাজিক তিনি ছোটবেলায় অনেক দেখেছেন। একজন যাদুকর শূন্য থেকে ডিম তৈরী করলেন। একটা ডিম থেকে দু’টা ডিম হল, তিনটা ডিম হল আবার মিলিয়ে গেল।
এই ছেলেটা ভাল ম্যাজিক দেখায় বলেই যে তাকে এখানে রাখা হয়েছে তা না। তার উপর মায়া পড়ে গেছে বলেই সে এখনো আছে। যেদিন মায়া কেটে যাবে তাকে চলে যেতে বলা হবে।
সংসারে একটা বাড়তি মানুষ পোষা সহজ ব্যাপার না। যে দিনকাল পড়েছে—নিজের আত্মীয় স্বজনদেরই কেউ জায়গা দেয় না আর এ-হল বাইরের অজানা অচেনা একজন মানুষ। এই যুগে অচেনা একজনকে বিশ্বাস করাও ঠিক না।
রাতে ঘুমোতে যাবার সময় সুরমার প্রায়ই মনে হয় ছেলেটা জ্বীন ভূত না-তো! মানুষের সংসারে জ্বীন এসে বাস করে এরকম গল্পতো প্রায়ই শোনা যায়। একটা গল্প আছে—মাদ্রাসার হোস্টেলে থেকে একটা জ্বীনের ছেলে পড়ে। পড়াশোনায় খুব ভাল। মাদ্রাসার সুপার একরাতে ছেলেটার ঘরের পাশ দিয়ে। যাচ্ছিলেন হঠাৎ তিনি কী মনে করে যেন ছেলেটার ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন। দেখলেন—ছেলেটা বিছানায় শুয়ে আছে! শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। হঠাৎ সে হাতের বইটা রেখে বইয়ের শেলফের দিকে হাত বাড়াল। বইয়ের শেলফটা ঘরের অন্য প্রান্তে, অনেকটা দূরে। তিনি স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন ছেলেটার হাত লম্বা হচ্ছে–লম্বা হচ্ছে তো হচ্ছেই। সাপের মতো হয়ে যাচ্ছে। মাদ্রাসার সুপার এই দৃশ্য দেখে ভয়ে বিকট চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এরপর থেকে ছেলেটাকে আর দেখা গেল না।