- বইয়ের নামঃ কবি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
আতাহারের পরনে পাঞ্জাবি
[সিলেটের মীরাবাজারের পুরানো শ্যাওলা ধরা দালানের একটা ঘর। মধ্যরাত্রি। পাঁচ-ছ বছর বয়েসী একটি শিশু বাবা-মার পাশে ঘুমুচ্ছে। বাইরে উথালি পাথাল জোছনা। সেই জোছনা বাড়ির ভেন্টিলেটর দিয়ে ঘরে ঢুকেছে, পড়েছে শিশুটির মশারির ছাদে। মনে হচ্ছে আলোর ফুল ফুটে আছে। হঠাৎ শিশুটির ঘুম ভেঙে গেল। সে বিস্ময় এবং ভয় নিয়ে তাকিয়ে রইল জোছনার ফুলের দিকে। এক সময় বাবাকে ডেকে তুলে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এটা কি? শিশুর বাবা ফুলের রহস্য ব্যাখ্যা করলেন–ভেল্টিলেটারে ফুলের নকশাকাটা। হয়ে মশারির ছাদে পড়েছে। ভয়ের কিছু নেই। শিশুর ভয় তারপরেও যায় না। তখন বাবা বললেন, হাত দিয়ে ফুলটা ধর, ভয় কেটে যাবে। শিশুটি সেই ফুল হাত দিয়ে ধরতে গেল। যতবারই ধরতে যায় ততবারই ফুল হাত গলে বের হয়ে যায়।
কবি–জোছনার ফুল ধরার গল্প। মহান বোধকে স্পর্শ করার আকাংক্ষার গল্প। জীবনকে দেখা এবং না দেখার গল্প।]
কবি উপন্যাসে কিছু কবিতা ব্যবহার করতে হয়েছে। অতি বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি কবিতাগুলি আমার লেখা। পাঠক ক্ষমা সুন্দর চোখে গ্ৰহণ করেছেন। কবিতাগুলিও করবেন–এই অসম্ভব আশা নিয়ে বসে আছি। ক্ষমা পেয়ে পেয়ে আমার অভ্যাস গেছে। খারাপ হয়ে।
–হুমায়ূন আহমেদ ধানমণ্ডি, ঢাকা।
০১.
আতাহারের পরনে পাঞ্জাবি।
পাঞ্জাবিতে ইস্ত্রি নেই, দলমচা ভাব। সেটা কোন ব্যাপার না–নতুন জামাইদের ক্ষেত্রেই ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি বাধ্যতামূলক, সে নতুন জামাই নয়। সমস্যা একটাই–পাঞ্জাবির পেটের কাছে হলুদ দাগ। মনে হয় গোশত দিয়ে ভাত খাবার পর কেউ একজন হাত না ধুয়ে পাঞ্জাবিতে হাত মুছে ফেলেছে। পাঞ্জাবি বদলে অন্য কিছু পরার মত সময় আতাহারের নেই–তাকে অতি দ্রুত বাড়ি থেকে বের হতে হবে। তার বাবা (অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার, বিদ্যাময়ী গার্লস হাইস্কুল), রশীদ আলি সাহেব এই মুহূর্তে বাথরুমে আছেন। তিনি খবরের কাগজ নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছেন। কাগজ শেষ করে বাথরুম থেকে বের হবেন। মিনিট কুড়ি লাগার কথা। এই সময়ের ভেতর অতিহারের হাওয়া হয়ে যেতে হবে। তা না করতে পারলে ভয়াবহ সমস্যা হতে পারে। রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। কিছুক্ষণ আগে রশীদ আলি সাহেবের সঙ্গে তাঁর পুত্রের দেখা হয়েছে। তিনি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিলেন–খবরের কাগজেৱ জন্যে অপেক্ষা। কাগজ আসছে না, তিনি বাথরুমে ঢুকতে পারছেন ন্যা) এমন সংকটপূৰ্ণ মুহুর্তে আতাহার কি জন্যে যেন বারান্দায় এসেছে। বাবাকে দেখে গেল। রশীদ আলি কিছুক্ষণ ছেলের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে ধমকের গলায় বললেন, কি রে, তুই মনিকার ফ্ল্যাট দেখতে গিয়েছিলি?
আতাহার সঙ্গে সঙ্গে বলল, জ্বি। যদিও সে যায়নি। সময় করে উঠতে পারেনি। বেকার যুকবদের নানান ধরনের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। সময় বের করা তাদের পক্ষেই সবচে কঠিন। এই তথ্য অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য। বাবাকে সত্য কথাটা বলা গেল না।
রশীদ আলি বললেন, পয়েন্ট বাই পয়েন্ট সব লিখে এনেছিস তো?
আতাহার বলল, হুঁ।
রশীদ আলি বিরক্ত গলায় বললেন, হুঁ হুঁ বলে জবাব দিবি না। কিছু জিজ্ঞেস করলে পুরো একটা সেনটেন্সে জবাব দিবি। সব লিখে এনেছিস?
জ্বি, লিখে এনেছি।
কোন ঘরের আয়না ভাঙা, বাথরুমের কি অবস্থা, দেয়ালে দাগ আছে কি-না। সব লিখেছিস?
লিখেছি।
রশীদ আলি বাথরুমে ঢুকলেন। আতাহার ঢুকল নিজের ঘরে। হাতের কাছের পাঞ্জাবিটাই গায়ে ঢুকিয়ে দিল। তাড়াহুড়ার সময় সব কাজে ঝামেলা হয়। পাঞ্জাবি গায়ে দেবার পর দেখা যায় পাঞ্জাবিটা উল্টো হয়েছে। বোতামের ঘর চলে গেছে পিঠের দিকে। স্যান্ডেল দুপাটির ভেতর এক পাটি খুঁজে পাওয়া যায়, অন্যপাটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তার পরম সৌভাগ্য–পাঞ্জাবি উল্টো হয়নি। স্যান্ডেলের দুপাটিই খাটের কাছে আছে। শুধু পাঞ্জাবির পেটের কাছে হলুদ দাগ। থাকুক দাগ। চাঁদের মত সুন্দর জিনিসেও কলংক আছে–আর পাঞ্জাবিতে থাকবে না তা-কি হয়! চাঁদের শোভা তার কলঙ্ক। পাঞ্জাবির শোভা হলুদ দাগ।
একতলার বারান্দায় মিলির সঙ্গে দেখা। মিলির মুখ শুকনা। চোখ ডেবে গেছে। গলায় কমলা রঙের মাফলার। মনে হয়। আবার তার টনসিালের সমস্যা হচ্ছে। সপ্তাহে তিন দিন তার টনসিল ফুলে থাকে। গলায় কমলা রঙের মাফলার জড়াতে হয়। মিলি বলল, তুই কি বেরুচ্ছিস না-কি ভাইয়া?
হুঁ।
নাশতা না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
মিলি আতাহারের ছবছরের ছোট। সে আতাহারকে তুই করে বলে। তার ভাবভঙ্গি এ রকম যেন সে এ বাড়ির বড় মেয়ে। সংসার দেখেশুনে নেয়ার দায়িত্ব তার। আজ আবার সে শাড়ি পরেছে। মায়ের ছাপা শাড়ি পরেছে বলেই কি গলার স্বরে মা মা ভাব?
শাড়ির রঙের সঙ্গে গলার স্বরের পরিবর্তন হয় কি? হলুদ শাড়ি যখন পরবে তখন গলার স্বর এক রকম, আকাশী নীল শাড়িতে অন্য রকম। পরীক্ষাটা করে দেখলে হয়। গবেষণামূলক একটা প্রবন্ধ হতে পারে। প্রবন্ধের শিরোনাম–দ্য ইফেক্ট অব কালার অন ইয়াং গার্লস ভয়েস।
ভাইয়া, তুই নাশতা-টাশত না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
আতাহার জবাব দিল না। জবাব দিয়ে নষ্ট করার মত সময় তার হাতে নেই। গেটের বাইরে এসে আতাহাব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিল–প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব নেয়া হয়েছে, না তাড়াহুড়ায় কিছু বাদ পড়ে গেছে? রুমাল পাওয়া গেল। এটা তেমন প্রয়োজনীয় না। তার সন্দি নেই যে নাকের সিকনি রুমালে ভরে পকেটে যত্ন করে রাখতে হবে। দেয়াশলাই পাওয়া গেল। এটা মোটামুটিভাবে জরুরি। একবার পকেটে সিগারেট থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র দেয়াশলাই-এর অভাবে সে সারারাত সিগারেট খেতে পারেনি।