সুপ্তি বলল, কথা বলছ না কেন মা? বাবলু কে?
ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার নাম দিয়েছি বাবলু। টুনুর নামে তাকে ডাকতে ইচ্ছা করে না।
খুব বেশিতো আর তাকে ডাকাডাকি করতে হবে না। আমার ধারণা নাশতা খেয়ে উনি চলে যাবেন।
চলে গেলে চলে যাবে–যা-তো বাবলুকে নাশতা দিয়ে আয়। নিয়ে যেতে পারবি তো?
কী বল তুমি পারব না কেন?
সুপ্তি নাশতার প্লেট এবং পানির গ্লাস নিয়ে যাচ্ছে। কী স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই যাচ্ছে। বারান্দায় মাঝামাঝি জলচৌকি রাখা ছিল—তার কাছাকাছি গিয়ে সে জলচৌকিটা এড়িয়ে দরজার দিকে যাচ্ছে। দিক ভুল হচ্ছে না। তিনি নিজে কতবার দরজায় হোঁচট খেয়েছেন—এই মেয়ে কখনো খায়নি। তবে এই মফস্বল শহরে অন্ধদের জন্যে আলাদা স্কুল নেই—মেয়েকে তিনি সাধারণ স্কুলেই ভর্তি করেছেন। সে পড়াশোনা করছে। ভালই করছে। তার হাতের লেখা ভাল না–এলোমেলো কিন্তু তা পড়া যায়। স্কুলের আপারা কষ্ট করে হলেও সেই লেখা পড়েন। সে পাস করে নতুন ক্লাসে ওঠে। এইবার মেয়ে ক্লাস এইটে উঠেছে। হয়ত একদিন এস.এস.সি’ও পাস করবে। তারপর কী হবে? কে এই মেয়েকে বিয়ে করবে?
সুরমার চোখে পানি এসে গেল। তিনি চোখে আঁচল চেপে বসে রইলেন।
ম্যাজিশিয়ান বসার ঘরের বিছানায় বসে আছে। সুপ্তি নাশতার পিরিচ নামাতে নামাতে বলল, আপনার ঘুম ভাল হয়েছে। ম্যাজিশিয়ান জবাব দিল না। তবে সুন্দর করে হাসল। যে হাসির অর্থ—”হ্যাঁ। খুব ভাল ঘুম হয়েছে। খুকী তুমি ভাল আছ?”
আপনি কি ভাপা পিঠা পছন্দ করেন? মা আপনার জন্যে ভাপা পিঠা বানিয়েছেন।
ভাপা পিঠা আমি খুব পছন্দ করি।
আপনি কি জানেন যে মা আপনাকে একটা নতুন নাম দিয়েছেন। সেই নামটা হল বাবলু। এখন আর আপনাকে আসল নামে ডাকা যাবে না। ভাল হয়েছে না?
হুঁ।
আপনাকে আসল নামে কেন ডাকা যাবে না সেটা জানেন?
ম্যাজিশিয়ান জবাব দিল না। সুপ্তি হাসতে হাসতে বলল, আমার একজন ভাই ছিল। তার নামও ছিল টুনু। আপনাকে টুনু বলে ডাকলে মা’র তার ছেলের কথা মনে পড়বে এবং খুব মন খারাপ হয়ে যাবে। এই জন্যে আপনাকে টুনু নামে ডাকা যাবে না।
ও আচ্ছা।
মা’র ধারণা আপনি দেখতেও অনেকটা আমার ভাইয়ার মতো।
তবে ভাইয়ার সঙ্গে আপনার সবচে বড় অমিল কী জানেন? সবচে বড় অমিল হচ্ছে ভাইয়া সারাক্ষণ কথা বলত। সে এক সেকেণ্ডও চুপ করে বসে থাকতে পারত না। এবং আমার মার ধারণা সে ঘুমের মধ্যেও কথা বলত। পিঠা খেতে কেমন হয়েছে?
খুব ভাল হয়েছে। তুমিও খাও।
সুপ্তি খাটের পাশে চেয়ারে বসল। তার খুব মজা লাগছে। আজ স্কুলে ম্যাজিশিয়ানের গল্প করতে হবে। এত কাছ থেকে সে এর আগে কোন ম্যাজিশিয়ান দেখেনি। উনি কয়েকদিন বাসায় থেকে গেলে ভাল হত। তার কাছ থেকে কয়েকটা সহজ ম্যাজিক সে শিখে রাখত। স্কুলের বন্ধুদের দেখিয়ে অবাক করে দিতে পারত। তবে মেয়েরা ম্যাজিক শেখে কি-না কে জানে। সে কোনদিন কোন মেয়ে ম্যাজিশিয়ানকে দেখেনি।
আচ্ছা আপনি কি আমার নাম জানেন?
জানি। তোমার নাম সুপ্তি।
আমি যে চোখে দেখতে পাই না সেটা কি জানেন?
হুঁ।
আপনার কি এই জন্যে খারাপ লাগছে?
ম্যাজিশিয়ান কিছু বলল না। সুপ্তি হাসতে হাসতে বলল—এত সুন্দর একটা মেয়ে চোখে দেখতে পায় না, এই ভেবে আপনার খারাপ লাগছে না?
লাগছে।
আপনি হয়ত বিশ্বাস করবেন না। আমার নিজের কিন্তু খারাপ লাগে না। কোনদিনও তো চোখে দেখিনি কাজেই চোখে দেখতে না পাওয়ার কষ্টটা আমি জানি না। অন্যরা যখন আমাকে দেখে আহা উহু করে তখন আমার খুব খারাপ লাগে। আপনি দয়া করে আহা উহু করবেন না।
আচ্ছা করব না।
আপনি কি আজ চলে যাবেন?
হ্যাঁ।
আপনার ম্যাজিক তো দেখা হল না?
তুমি তো চোখে দেখতে পাও না। ম্যাজিক কীভাবে দেখবে?
আমি কল্পনা করে করে দেখি। আপনি কী দেখাচ্ছেন সেটা বললেই আমি বাকিটা কল্পনা করে নেবো। নাশতা খেতে খেতে একটা ম্যাজিক দেখান না। ভাপা পিঠাটা খেয়ে ফেলবেন কিছুক্ষণ পর কান দিয়ে কিংবা নাক দিয়ে সেই পিঠা বের করবেন। হি হি।
ম্যাজিশিয়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মুখটাও হাসি হাসি। সুপ্তি বলল, এই যে আমি হি হি করে হাসছি আপনি রাগ করছেন না তো?
না।
ক্লাসেও আমি সারাক্ষণ হি হি করে হাসি। এই জন্যে ক্লাসে আমার নাম হিহি রাণী। নামটা সুন্দর না?
হ্যাঁ।
ক্লাসের মেয়েরা কী বলে জানেন? তারা বলে আমার যার সঙ্গে বিয়ে হবে সে হা হা করে হাসবে। এবং তার নাম হবে হাহা রাজা। হাহা রাজার বউ হিহি রাণী। বক বক করেই যাচ্ছি আপনি রাগ করছেন না তো?
না।
এখন একটা ম্যাজিক দেখান। কারণ ক্লাসের মেয়েদের কাছে আমাকে গল্প করতে হবে। সুন্দর একটা ম্যাজিক দেখান।
ম্যাজিশিয়ান বলল, আচ্ছা দেখাচ্ছি। এক থেকে দশের মধ্যে একটা সংখ্যা ভাবো।
সুপ্তি ভাবল—তিন। কারণ তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন। ভাইয়া বেঁচে থাকলে সে ভাবত চার। ভাইয়া যেহেতু বেঁচে নেই— কাজেই তিন।
ভেবেছ?
হুঁ।
ম্যাজিশিয়ান বলল, চার বিয়োগ এক। হয়েছে?
হুঁ হয়েছে। কিন্তু আপনি সরাসরি তিন না বলে চার বিয়োগ এক বললেন কেন?
এম্নি।
আচ্ছা আমি মনে মনে একটা ফুলের কথা ভাবছি। বলুন তো কী ফুল?
ম্যাজিশিয়ান হাসল কিছু বলল না। সুপ্তি বলল, পারছেন না, তাই না?
ম্যাজিশিয়ান তারও জবাব দিল না। সুপ্তির মন একটু খারাপ হল। তার ধারণা ম্যাজিশিয়ান বলতে পারবে। সে খুব সহজ ফুল ভেবেছিল—বেলীফুল। সুপ্তি বলল, আপনার ম্যাজিক কিন্তু খুব ভাল না। মোটামুটি।