ম্যাজিশিয়ায় বললো, তুমি ভাল আছ? বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে খেতে শুরু করলো।
সুপ্তির সারা শরীর কেঁপে উঠল। এই ম্যাজিশিয়ানের গলার স্বর অবিকল তার ভাইয়ার মত। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর টুনু ভাইয়া ফিরে এসেছে। তাকে জিজ্ঞেস করছে—তুমি ভাল আছ?
মবিন উদ্দিন ম্যাজিশিয়ানের সামনের একটা চেয়ারে বসে আছেন। তিনি সিগারেট ধরিয়েছেন। তাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। কারণ ছেলেটিকে এখন আর কালো লাগছে না। মনে হচ্ছে তার গায়ের রং ফর্সা। শুধু ফর্সাই না বেশ ফর্সা। তিনি কী এতক্ষণ ভুল দেখেছিলেন? ম্যাজিশিয়ান ছেলে কোন রকম ম্যাজিক ট্যাজিক করছে না তো? ম্যাজিশিয়ানরা অনেক সময় চোখে ধান্ধা লাগিয়ে ফেলে সে রকম কিছু।
বাড়ির ভেতর থেকে সুরমা বিরক্ত গলায় ডাকলেন, সুপ্তি। এই সুপ্তি।
সুপ্তির ভেতরে যেতে ইচ্ছা করছে না। সে অপেক্ষা করছে ম্যাজিশিয়ান যদি আর কোন কথা বলে। কতো কথাইতো বলার আছে “রান্না ভালো হয়েছে। কিংবা আজ খুব শীত পড়েছে।” অথচ সে আর কিছুই বলছে না। নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। সুরমা আবারো ডাকলেন এই সুপ্তি! ডাকছি কানে যাচ্ছে না? সে নিতান্ত অনিচ্ছায় ভেতরে গেল। সুরমা বললেন, তুই ওখানে বসে আছিস কেন?
সুপ্তি ফিস ফিস করে বলল, ম্যাজিশিয়ানের কথা শুনছি মা।
কথা শোনার কী আছে?
সুপ্তি বলল, মা তুমি ওনার গলার স্বরটা একটু শুনে যাও। তুমি খুব চমকে যাবে। তোমার বুকে একটা ধাক্কার মতো লাগবে।
আজগুবি কথা বলিস কেন? রাস্তার একটা ফালতু লোকের গলার স্বর শোনার কী আছে?
শোনার একটা জিনিস আছে মা। না শুনলে বুঝবে না। জানালার পাশে এসে একটু দাঁড়াও।
সুরমা জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি মুখ তুলে তাকাল। সুরমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল——টুনু বসে আছে। অবিকল টুনু। এতে কোন রকম সন্দেহ নেই। সুরমার মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মতো হল। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করতো এই ছেলের নাম কী?
সুপ্তি ফিসফিস করে বলল, মা উনার নাম টুনু। বাবা তাই বলল। সুরমা তাকিয়ে আছেন। তিনি তার চোখের দৃষ্টি ফেরাতে পারলেন না।
বারান্দার তোলা উনুনে ভাপা পিঠা
বারান্দার তোলা উনুনে ভাপা পিঠা বানাতে বসেছেন। এটি একটি বিস্ময়কর ঘটনা এই কারণে যে এ বাড়িতে গত ছয় বছরে ভাপা পিঠা হয়নি। এই পিঠা টুনুর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। শীতকাল এলেই টুনু রোজ ঘ্যান ঘ্যান করবে মা পিঠা কর—ভাপা পিঠা। খুব যখন ছোট ছিল তখন সে পিঠা হাতে নিয়ে বারান্দায় রোদে বসে থাকতো। গরম পিঠা–গা থেকে ভাপ উঠছে। টুনু একটু পরপর সেই পিঠা নাকের কাছে নিয়ে খেজুর গুড়ের গন্ধ নিচ্ছে এটা ছিল শীতকালের সাধারণ দৃশোর একটা।
সুপ্তি চুলার পাশে এসে বসল। আগুনের উপর হাত মেলতে মেলতে বলল, ভাপা পিঠা বানাচ্ছ তাই না-মা? নারিকেল দাওনি কেন?
সুরমার বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। কী আশ্চর্য এই মেয়ে চোখে কিছু দেখছে অথচ এমনভাবে কথা বলছে যেন সব দেখছে। পিঠায় নারিকেল দেয়া হয়নি এটাও ধরতে পারছে।
হঠাৎ করে ভাপা পিঠা কেন মা?
সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, তাতে অসুবিধা কী হয়েছে। ঘরে চালের গুড়া ছিল, খেজুর গুড় ছিল।
সুপ্তি ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বলল, তুমি ভাপা পিঠা কর না তো, আজ হঠাৎ করলে।
বাড়িতে একজন মেহমান এসেছে। পিঠা চিড়া করব না?
মেহমান কে? কার কথা বলছ?
বাবলু।
সুপ্তি বিস্মিত হয়ে বলল, বাবলু? বাবলু কে?
সুরমা একটু যেন লজ্জা পেলেন। ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার তিনি নতুন নাম দিয়েছেন—বাবলু। তাকে টুনু নামে ডাকতে ইচ্ছা করছে না। এম্নিতেই টুনুর সঙ্গে ছেলেটার খুব মিল। তার উপর যদি নামও হয় টুনু তাহলে অনেক সমস্যা।
আজ ফজরের সময় নামাজের অজু করতে উঠে দেখেন— টুনু সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে জবুথুবু হয়ে বসে আছে। সুরমা বললেন, “তুই এত সকালে ঘুম থেকে উঠেছিস কেন?” বলেই মনে হল—কী সর্বনাশ! কাকে কী বলছেন? এতো টুনু না। ম্যাজিশিয়ান ছেলেটা। ছিঃ ছিঃ কী হল। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, বাবা তুমি কিছু মনে করো না। আমি আসলে—
ম্যাজিশিয়ান ছেলেটা বলল, আমি কিছু মনে করি নি। আমার সঙ্গে আপনার বড় ছেলের চেহারার মিল আছে এটা আমি বুঝতে পারছি। এই জন্যেই আপনি ভুলটা করেছেন।
তোমার নাম কি আসলেই টুনু?
জ্বি।
এই নামটা বদলে তোমাকে যদি অন্য কোন নামে ডাকি তুমি কি রাগ করবে?
জ্বি-না। আপনার যে নামে ডাকতে ইচ্ছা করে আপনি ডাকবেন।
বাবলু ডাকি?
জ্বি অবশ্যই। বাবলু নামটাও সুন্দর।
ফজরের ওয়াক্ত পার হয়ে যাচ্ছে—সুরমা কলঘরে অজু করতে গেলেন। বাবলু পিছনে পিছনে আসছে। কল টিপে দিতেই আসছে নিশ্চয়ই। টুনুও তাই করত—কোন ব্যাপারেই মা’র কোন সাহায্যে সে এগিয়ে আসবে না—শুধু কলঘরে মা’কে যেতে দেখলে সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসবে। চাপকলে পানি তুলতে তার কোন আপত্তি নেই।
বাবলু চাপকলে পানি তুলছে তিনি অজু করছেন। অজুর সময় আল্লাহ ছাড়া কারো কথাই মনে করতে নেই তার একী হল শুধু টুনুর কথা মনে আসছে এবং চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। মুখে অজুর পানি দেয়া বলে চোখের পানি আলাদা করা যাচ্ছে না।
মজার ব্যাপার হল, বাবলু নামটাও আসলে টুনুরই নাম। সবাই টুনুকে টুনু ডাকলেও তিনি ডাকতেন বাবলু। বাবু থেকে বাবলু। শেষ পর্যন্ত টুনু নামটাই টিকে গেল। ভর দেয়া নাম টিকল না।