তোমার দেশ কোথায়?
সে হাসল। প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছা না হলে মানুষ যে ভঙ্গিতে হাসে সেই রকম হাসি।
তোমার দেশ কোথায় বলতে চাচ্ছ না?
সে না সূচক মাথা নাড়ল।
বলতে কী তোমার কোন অসুবিধা আছে? অসুবিধা থাকলে বলার দরকার নেই।
মবিন উদ্দিন চিন্তিত মুখে সিগারেট ধরালেন। নতুন এক দুঃশ্চিন্তায় তিনি এখন আক্রান্ত হয়েছেন। অচেনা অজানা একটা ছেলেকে দুপুর রাতে বাসায় নিয়ে তুলছেন। সুরমা ব্যাপারটা কীভাবে নেবে কে জানে। খুব ভাল ভাবে নেবার কথা না। সুরমা অল্পতেই রেগে যায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্নেহ মমতা কমতে থাকে, রাগ বাড়তে থাকে। সুরমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তবে অন্যের তুলনায় বেশি ঘটেছে।
ফাঁকা রাস্তায় রিকশা খুব দ্রুত চলছে। বাতাসের কারণে শীতটা দশগুণ বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। ঠাণ্ডা বাতাস নাক মুখ আর কানের ফুটো দিয়ে ভেতরে টুকে যাচ্ছে। তিনি থরথর করে কাঁপছেন, অথচ ছেলেটা চুপচাপই বসে আছে। গায়ের গরম শালের একটা অংশ কী ছেলেটাকে দিয়ে দেবেন? মন ঠিক করতে করতে রিকশা বাসার সামনে এসে থামল।
ছেলেটাকে নিয়ে সরাসরি বাসায় ঢোকার সাহস তাঁর হল না। সুরমা কী জাতীয় হৈ চৈ শুরু করবে কে জানে। রেগে গেলে তার কথাবার্তারও কিছু ঠিক থাকে না।
ছেলেটাকে তিনি রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। শুকনো গলায় বললেন, একটু দাঁড়াও আমি ডেকে নিয়ে যাব। তিনি ভয়ে ভয়ে দরজার কড়া নাড়লেন, দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করলেন, সুরমাকে ব্যাপারটা কীভাবে বলবেন। আসলে বড় ভুল হয়ে গেছে রিকশাতেই ভেবে টেবে ঠিক করে রাখা দরকার ছিল। রিকশায় সারাক্ষণ তিনি তাঁর ছেলের কথা ভেবেছেন।
তৃতীয়বার কড়া নাড়তেই তাঁর মেয়ে সুপ্তি দরজা খুলে দিল। সুপ্তির দিকে তাকিয়ে মবিন উদ্দিনের মন খারাপ হয়ে গেল।
আহারে কী সুন্দর তার এই মেয়েটা। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চোখ আল্লাহ্ তার এই মেয়েকে দিয়েছেন। কী ঘন কালো চোখ। দীর্ঘ পল্লব। অথচ সুপ্তির এই চোখ কোনো কাজে আসে না। সুপ্তি চোখে দেখে না।
মবিন উদ্দিন বললেন জেগে আছিস নাকি মা?
সুপ্তি বললো, না ঘুমোচ্ছি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দরজা খুললাম।
সুপ্তির বয়স বারো। সে চাদরে শরীর ঢেকে মাথাটা এমন ভাবে বের করেছে যে তাকে অনেক বড় বড় লাগছে। মবিন উদ্দিন ভেবে পেলেন না, মেয়েটা এত রাত পর্যন্ত জেগে আছে কেন, অবশ্যি জেগে থাকায় ভালই হয়েছে শুরুতেই তাকে স্ত্রীর মুখোমুখি হতে হয়নি। নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাওয়া গেছে। তাছাড়া সুপ্তি তার বাবাকে অনেকবার মার ব্লগ থেকে উদ্ধার করেছে। হয়তো এবারো করবে। মবিন উদ্দিন নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, মা জেগে আছে?
হুঁ। এত রাত হয়েছে আমরা ভেবেছিলাম তুমি আসবে না।
তুই এত রাত পর্যন্ত জেগে আছিস কেন?
সুপ্তি জবাব দেবার আগেই সুরমা চলে এলেন, কঠিন গলায় বললেন, রাত দুপুরে আসার দরকার ছিল কী? থেকে গেলেই পারতে। খেয়ে এসেছ তো?
হুঁ।
দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এটা আবার কী রকম ঢং, ভেতরে আস।
মবিন উদ্দিন ইতস্তত করে বললেন, আমার সঙ্গে একটা ছেলে আছে। ও চারটা ভাত খাবে।
সুরমা গলার স্বর তীক্ষ্ণ করে বললেন, তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। ছেলে আছে মানে কী? তুমি ছেলে পেয়েছ কোথায়?
রাস্তায় ম্যাজিক দেখাচ্ছিল। সারাদিন কিছু খায়নি। ভাবলাম চারটা ভাত খাইয়ে দেই।
ম্যাজিক ফ্যাজিক দেখানো লোকজন তুমি রাত একটার সময় বাসায় নিয়ে আসছ এর মানে কী? হঠাৎ এত দরদ উথলে উঠল কেন?
একটা ছেলে না খেয়ে আছে।
কত জনেইতো না খেয়ে আছে। তাদের কোলে করে বাসায় নিয়ে আসতে হবে?
মবিন উদ্দিন অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। সুপ্তি বাবার সাহায্যে এগিয়ে এল। সে মার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, বাবার ভাততো বাড়াই আছে দিয়ে দাও খেয়ে চলে যাক। আচ্ছা থাক তোমাকে দিতে হবে আমি এনে দিচ্ছি। আমার কোনো অসুবিধা হবে না আমি পারবো। মা তুমি গিয়ে শুয়ে পড়।
সুরমা মুখ গম্ভীর করে চলে গেলেন। সুপ্তি বলল, তোমার মজিশিয়ান কোথায় বাবা?
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।
রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন আছে কেন?
তোর মা’র ভয়ে আমিই দাঁড় করিয়ে রেখেছি। তোর মা হ্যাঁ বললে বাসায় নিয়ে আসব। এই ছিল পরিকল্পনা।
ডেকে নিয়ে এসো।
মুবিন উদ্দিন টুনুকে ডাকতে গেলেন। দরজা ধরে সুপ্তি দাঁড়িয়ে আছে। তার বাবা রাত একটার সময় ম্যাজিশিয়ান ধরে নিয়ে এসেছেন এই ব্যাপারটা তার কাছে খুব অদ্ভুত লাগছে। খাওয়ার পর ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোক কী দু’একটা ম্যাজিক দেখাবেন? দেখাবেন হয়ত। গায়কদের গান গাইতে বললে তারা নানান অজুহাত তোলে, গলা ঠিক নেই ঠাণ্ডা লেগে গলা বসে গেছে, মুড নেই। ম্যাজিশিয়ানদের ম্যাজিক দেখাতে বললে তারা সঙ্গে সঙ্গে দেখায়। না বললেও দেখায়। ইনিও নিশ্চয়ই দেখাবেন, দেখালেও সে দেখতে পাবে না। তাতে অসুবিধা নেই। কী ম্যাজিক হচ্ছে তা বলে দিলেই সে কল্পনা করতে পারবে। সুপ্তির ধারণা তার কল্পনার ম্যাজিক—আসল ম্যাজিকের চেয়ে ভালো।
ছেলেটি খেতে বসেছে। বসার ঘরের টেবিলে তাকে খেতে দেয়া হয়েছে। ভাত তরকারী সবই ঠাণ্ডা। রাস্তার একটা ফালতু মানুষ খাবে তার জন্যে ভাত তরকারী গরম করার প্রশ্ন ওঠে না। ছেলেটা ঠাণ্ডা খাবারই খাচ্ছে। বেশ আরাম করে খাচ্ছে। তার খাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে খুব ক্ষুধার্ত। প্লেট থেকে একবার মুখ তুলে সুপ্তিকে দেখলো তার চোখে সামান্য হলেও বিস্ময় ঝিলিক দিল। মবিন উদ্দিন বলেন, এ হল সুপ্তি আমার মেয়ে। আমার একটাই মেয়ে। আর সুপ্তি এই ম্যাজিশিয়ানের নাম—টুনু।