সে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে হাসল।
তোমার নাম কি?
সে আবারো হাসল।
আচ্ছা ছেলেটাকে সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে গেলে কেমন হয়? বাসায় নিয়ে চারটা গরম ভাত খাইয়ে দেয়া। তাকে বললে সে কি যাবে? মনে হচ্ছে যাবে। মবিন উদ্দিন ইতস্তত করতে লাগলেন।
অচেনা একজন মানুষকে দুপুর রাতে হুট করে বাড়িতে নিয়ে আসা যায় না। তাছাড়া পথে ঘাটে যারা ম্যাজিক দেখায় তারা খুব সুবিধার মানুষ হয় না। ধান্ধাবাজ মানুষই ম্যাজিশিয়ান হয়। এরা দিনে ম্যাজিক দেখায় রাতে চুরি চামারি করে। ছেলেটাকে অবশ্যি ধান্ধাবাজ মনে হচ্ছে না। ধান্ধাবাজ মানুষ কথা বেশি বলে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে হড়হড় করে কথা বলে। এই ছেলে কথা বলছেই না। বোবা-কালা নাতো? নিশ্চিত হবার জন্যে মবিন উদ্দিন আবারো জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?
সে জবাব দিল না। মাথা নিচু করে হাসল। মবিন উদ্দিন বললেন, কথা বলতে পার না?
পারি।
পার তাহলে কথা বলছ না কেন?
সে আবারো হাসল। ছেলেটার হাসি সুন্দর। ধান্ধাবাজ মানুষ সুন্দর করে হাসতে পারে না তাদের হাসির মধ্যেও একটা কিন্তু থাকে। আচ্ছা ছেলেটাকে বইয়ের দোকানে একটা চাকরি দিয়ে দিলে কেমন হয়? সেলসম্যান। পেটে ভাতে থাকবে। মাঝে মধ্যে কিছু হাত খরচ। না বইয়ের দোকানের চাকরি দেয়া যাবে না। বইয়ের দোকানে চাকরি করতে হলে পড়াশোনা জানতে হয়। পথে ঘাটে যারা ম্যাজিক দেখায় তারা পড়াশোনা জানে না। তারা ক অক্ষর শুকর মাংস টাইপ হয়।
তুমি কি লেখা পড়া কিছু জান? বই পড়তে পার?
ছেলেটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। মর্কিন উদ্দিনের মনটা ভাল হয়ে গেল। তিনি হাসি মুখে বললেন, তোমার ম্যাজিক দেখে সন্তুষ্ট হয়েছি। ভাল ম্যাজিক। যাই হোক তুমি কী খাওয়া দাওয়া কিছু করেছ?
ছেলেটা না সূচক মাথা নাড়ল। মবিন উদ্দিনের মনে হল প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। একটা মানুষ এত রাত পর্যন্ত না খেয়ে বসে আছি এটা জানার পর তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায় না। সারা পৃথিবীতে বহু লোক রাতে না খেয়ে ঘুমুতে যায়। তাতে আমাদের খারাপ লাগে না কারণ আমরা কাউকে জিজ্ঞেস করি না সে খেয়েছে কি না।
তোমার শীত লাগছে না?
সে না সূচক মাথা নাড়ল। এই প্রচণ্ড শীতে হাফসার্ট গায়ে দিয়ে সে বসে আছে আর বলছে, শীত লাগছে না। এটা একটা কথা হল। শীত অবশ্যই লাগছে। স্বীকার করছে না। গায়ের শালটা কি তাকে দিয়ে দেবেন? এটা কি ঠিক হবে? না ঠিক হবে না। সুরমা জানতে পারলে হৈ চৈ করে বাড়ি মাথায় তুলবে। বরং তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায়। বাড়িতে নিয়ে পুরানো চাদর টাদর কিছু দিয়ে দিলেই হবে। চারটা ভাত খাইয়ে, একটা চাদর দিয়ে বিদায়। সেলসম্যানের চাকরি দিয়ে বাড়িতে রেখে দেয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই সংসার চলে না। আরেকটা বাড়তি মুখ।
মবিন উদ্দিন গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, তুমি চল আমার সঙ্গে।
ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। দেরি করল না। যেন সে তার সঙ্গে যাবার জন্যে তৈরী হয়েই বসে ছিল।
তোমার নাম কী তাতো এখনো জানা হল না।
কি বললে নাম?
ও আচ্ছা আচ্ছা।
মবিন উদ্দিন বেশ অস্বস্তি বোধ করছেন। টুনু তার বড়ছেলের নাম, পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। পাঁচ বছর দীর্ঘ সময়–প্রায় অর্ধযুগ, তবু মনে হয় এইতো সেদিন। সবকিছু ছবির মতো ভাসে।
টুনু নেত্রকোনা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়তো। হঠাৎ খবর এল তার প্রচণ্ড পেটে ব্যথা। কলেজ থেকে তাকে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন সন্ধ্যা। তার নিজের শরীর ভাল লাগছে না বলে আগে ভাগে দোকান বন্ধ করে ঘরে ফেরার কথা ভাবছেন। তখনি খবরটা এল। তিনি হাসপাতালে ছুটে গেলেন। ছেলের সঙ্গে দেখা হল না। তাকে বলা হল কিছুক্ষণ আগে এপেনডিক্স অপারেশন হয়েছে। সে আছে পোস্ট অপারেটিভ রুমে। জ্ঞান ফেরেনি, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। পোস্ট অপারেটিভ রুমে কারোর প্রবেশ নিষেধ। তিনি হাসপাতালের বারান্দায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একজন ডাক্তার এসে সান্ত্বনা দিলেন—আপনি এত নার্ভাস হয়ে গেছেন কেন। এপেনডিক্স অপারেশন কোন ব্যাপারই না। ফোড়া কাটার মতো। পার্থক্য একটাই– এই ক্ষেত্রে ফোঁড়াটা শরীরের ভেতরে। যান এক কাপ চা খেয়ে এসে খোঁজ নিন। ততক্ষণে ছেলের জ্ঞান ফিরে আসবে। তার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। তিনি চা খেতে গেলেন। ফিরে এসে শুনলেন ছেলে মারা গেছে। মৃত্যুর আগে তার জ্ঞান ফিরে এসেছিল।
সে ফিস ফিস করে বলেছিল, বাবা আসেনি? বাবা?
চা খেতে না গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে ছেলের সঙ্গে তার দেখা হতো। সামান্য এক কাপ চায়ের জন্যে ছেলের সঙ্গে তার শেষ দেখা হল না।
এরপর থেকে তিনি চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আজ প্রায় ছয় বছর হল তিনি চা খান না।
যাদুকরের নামও টুনু। এটা কি বিস্মিত হবার মতো কোন ঘটনা?
বিস্মিত হবার মতো কোন ঘটনা না। টুনু খুব কমন নাম অনেকেরই থাকে। টুনটুনি থেকে টুনু। এই যাদুকরের বাবা-মা ছেলের নাম টুনু রেখেছেন। তাহলে তিনি এত অস্বস্তি বোধ করছেন কেন? সমস্যাটা কী?
মবিন উদ্দিন রিকশায় উঠে সমস্যা ধরতে পারলেন। তিনি বুকের ভেতর এক ধরনের কাঁপন অনুভব করলেন। যাদুকরের সঙ্গে কোথায় যেন টুনুর একটা মিল আছে। মিলটা কোথায়? টুনুর গায়ের রং ছিল ধবধবে শাদা। রূপকথার বই-এ দুধে আলতা রং বলে একটা কথা পাওয়া যায় অবিকল সেই ব্যাপার। নজর লাগবে বলে তার মা অনেক বয়স পর্যন্তু তার কপালে এত বড় একটা কাজলের টিপ দিয়ে রাখতো। যাদুকরের গায়ের রং কুচকুচে কালো। টুনু সারাক্ষণ বকবক করতো তার কথার যন্ত্রণায় তিনি নিজে কতবার বলেছেন— একজন জুতা সেলাই ওয়ালা ডেকে টুনুর মুখটা সেলাই করে দেয়া দরকার। আর এদিকে যাদুকর ছেলেটা কথাই বলে না। যে কোন প্রশ্ন দু’তিন বার করে করতে হয়। চেহারায় কি কোন মিল আছে? না চেহারাতেও মিল নেই। টুনুর মুখ ছিল লম্বাটে। এই ছেলেটির মুখ গোলাকার। টুনুর চুল ছিল কোঁকড়ানো। এর চুল কোকড়ানো না। তাহলে ছেলের সঙ্গে মিলের ব্যাপারটা মাথায় আসছে কেন? কেন মনে হচ্ছে এই ছেলের সঙ্গে টুনুর মিল আছে? মবিন উদ্দিন বাধার মধ্যে পড়ে গেলেন।