তিনি তখন অস্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারলেন, তাকে নিয়ে রসিকতা শুরু হয়ে গেছে। তার বিব্রত ভঙ্গি দেখে দর্শক হাসতে শুরু করেছে। কোন বুদ্ধিমান ম্যাজিশিয়ানই দর্শকদের হাসানোর এই সুযোগ নষ্ট করবে না। চেংড়া ম্যাজিশিয়ানও করল না। মধুর গলায় বলল, বলেন ভাইজান বলেন। নাম বলেন। বুলন্দ আওয়াজে বলেন।
তিনি নাম বললেন। ততক্ষণে তার কপাল ঘামতে শুরু করেছে। পা কাঁপছে। একী বিপদে পড়া গেল!
আচ্ছা ভাইজান সত্যি কইরা বলেন দেহি আপনি মানুষ না মুরগী?
এই অপমানকর, হাস্যকর প্রশ্নের তিনি কী জবাব দেবেন? ভয় এবং আতংকে তার বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। ম্যাজিশিয়ান ফিস ফিস করে বলল, মুরগী হইলে কোঁকর কোঁ কইরা একটা ডাক দেন। দেন ডাক দেন।
কোঁকর কোঁ করে ডাক দেবার বদলে তিনি কপালের ঘাম মুছলেন। ম্যাজিশিয়ান তার হাত ধরল, কানের কাছে মুখ নিয়ে গানের মতো করে বলল,
মুরগী বলে কোঁকর কোঁ
মোরগ বলে কী গো? তোমার হইছে কী?
দর্শক হেসে প্রায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তিনি মনে মনে বললেন, আল্লাহ তুমি আমাকে একী অপমানের মধ্যে ফেললে?
অপমানের তখন মাত্র শুরু। এরপর যা আরম্ভ হল তা ভাবলে তিনি এখনো শিউরে ওঠেন। চেংড়া ম্যাজিশিয়ান তাঁর পাঞ্জাবির পেছনে হাত দিয়ে একটা ডিম বের করে নিয়ে এল। তারপর ডিম আনতেই শুরু করল। একসময় গম্ভীর গলায় বলল, ভাইজান দেহি বিলাতী মুরগী। ডিম পাড়তেই আছে পাড়তেই আছে।
পুতুল হাতে এই যাদুকর চেংড়া ম্যাজিশিয়ানের মতো না। সে তাঁর দিকে এখনও তাকিয়ে আছে। সেই তাকানোয় মমতা আছে। তার চোখের দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে–সে কাউকে অপমান করবে না। কয়েকটা পুতুল নিয়ে মজার কিছু খেলা দেখাবে। সম্ভবত টাকা পয়সাও চাইবে না। কেউ দিলে দেবে, না দিলে না।
ম্যাজেশিয়ানদের নিয়মই হচ্ছে বকবক করা। অকারণে কথা বলে লোকজনদের বিভ্রান্ত করা। এই লোক তাও করছে না। মবিন উদ্দিন অনেকক্ষণ হল দাঁড়িয়ে আছেন এখন পর্যন্ত তিনি ম্যাজিশিয়ানের কোন কথা শোনেননি। এই যাদুকরের গলার স্বর নিশ্চয়ই গৌরীপুরের চেংড়া ম্যাজিশিয়ানের মতো কর্কশ না। তার গলার স্বর শুনতে পারলে ভাল লাগতো। যাদু দেখানো শেষ হলে সে এক সময় কথা বলবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। এম্নিতেই দেরি হয়ে গেছে। আরে আরে একী! পুতুলগুলি দেখি বেলী ফুল হয়ে গেছে। ম্যাজিশিয়ানের হাত ভরতি বেলী ফুল। আর কী গন্ধ ফুলের। তিনি এতদূর থেকেও গন্ধ পেলেন।
মবিন উদ্দিন বড় রাস্তার দিকে রওনা হলেন। তাঁর মন একটু খুঁত খুঁত করতে লাগলো, যাদুকরকে পাঁচটা টাকা দিয়ে এলেও পারতেন। এই প্রচণ্ড শীতে বেচারা শুধু পাতলা একটা সার্ট গায়ে দিয়েছিল। আহারে।
একটা বিস্ময়কর ব্যাপার মবিন উদ্দিন লক্ষ্য করলেন না। তার গন্ধ সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। তিনি ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ পাচ্ছেন না। তাকে নর্দমা টপকে যেতে হল। যেখানে একটা কুকুর মরে গলে পড়ে আছে। তার পচা শরীর থেকে বিকট গন্ধ আসছে। তিনি সেই বিকট গন্ধও পেলেন না। তার নাকে বেলী ফুলের মিষ্টি সৌরভ লেগে রইল।
.
বিয়ের আলাপ শেষ হল রাত এগারোটায়। মবিন উদ্দিনের বিরক্তির সীমা রইল না। একই কথা ছ’বার সাত বার করে বলা হচ্ছে। সামান্য একটা তারিখ ঠিক করা নিয়ে এত কথা বলারই বা কী আছে?
বিয়ের তারিখ ঠিক হল মাঘ মাসের ১ তারিখ, শুক্রবার। জুমার নামাজের পর এজিন কাবিন হবে। চল্লিশ হাজার টাকা কাবিন, অর্ধেক জেওরপাতিতে উসুল। ছেলেকে দিতে হবে একটা মোটর সাইকেল আর কিছু না। মোটর সাইকেলের তার নাকি খুব শখ। মোটর সাইকেলের বাইরে যদি মেয়ের বাবা-মা শখ করে কিছু দিতে চায় দিবে। তবে পাত্র পক্ষের কোন দাবী নাই।
আলোচনার শেষে খাওয়া দাওয়া। কোরমা, পোলাও, ঝাল গোসত, ফিরনি। প্রচুর আয়োজন। রাহেলার রান্না ভাল। মবিন উদ্দিন আরাম করে খেলেন। ঘরে ফেরার জন্যে যখন উঠলেন তখন রাত বাজে বারোটা।
রাহেলা বলল, ভাইজান রাতটা থেকে যান। শীতের মধ্যে কোথায় যাবেন?
মবিন সাহেব থেকে যেতে পারতেন। বাসায় বলেও এসেছেন বেশি দেরী হলে থেকে যাবেন। থেকে গেলে তাকে নিয়ে বাসায় কেউ দুঃশ্চিন্তা করবে না। কিন্তু থাকতে ইচ্ছা করছে না। কেন জানি অস্থির লাগছে।
এত রাতে রেল স্টেশন ছাড়া কোথাও রিকশা পাওয়া যাবে না। মবিন উদ্দিন রেল স্টেশনের দিকে রওনা হলেন।
বাইরে কনকনে হাওয়া বইছে। মবিন উদ্দিনের মনে হল গত কুড়ি বছরে না, চল্লিশ বছরেও নেত্রকোনায় এত শীত পড়েনি। রাহেলার বাড়িতে রাতটা থেকে গেলেই হত। এত রাতে বের হওয়া বোকামী হয়েছে। এই বয়সে বুকে ঠাণ্ডা বসে গেলে সমস্যা হবে।
মবিন উদ্দিন কোন রিকশা পেলেন না। একজন বুড়ো রিকশাওয়ালা পাওয়া গেলো সে এত দূরের পথে যাবে না। তিনি যখন মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন রাতটা রাহেলার বাসাতেই কাটাবেন তখনই কালো যাদুকরকে দেখলেন। টিকিট ঘরের সিড়িতে বসে আছে। হাসি মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। তাকে ঠিক আগের মতো লাগছে না। একটু যেন অন্য রকম লাগছে। আগে গায়ে গোলাপী রঙের সার্ট ছিল। এখন সার্টের রঙ মনে হল নীল। মাথার চুল ছিল কোঁকড়ানো। এখন সেরকম মনে হচ্ছে না। বয়সও অনেক কম মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা কী? মবিন উদ্দিন কালো যাদুকরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ইতস্ততঃ করে বললেন, দরজি পট্টিতে তুমি কি ম্যাজিক দেখাচ্ছিলে?