টগর!
কী বাবা?
তুই আমার দিকে এ রকম করে তাকিয়ে আছিস কেন?
এম্নি।
আমি এখন অবাক হয়ে বাবার মনের ভেতরে আরেকটি ব্যাপার দেখছি— এখন তিনি আর আমার মার কথা ভাবছেন না। তিনি ভাবছেন—শিউলি গাছটার কথা। আহা গাছটা মরে যাচ্ছে। কঠিন এক অসুখ শরীরে নিয়ে মরে যাচ্ছে। বেচারা নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাচ্ছে।
আমি দেখলাম, বাবার চোখ ছল ছল করছে। বাবার মতো ভবগুরে মানুষের অন্তরটা যে এত ভাল তা এই প্রথম বুঝলাম।
.
নতুন জীবনে আমি অভ্যস্ত হতে পারছিলাম না। কোনদিন পারব বলেও মনে হচ্ছে না। নিজের মধ্যে প্রচও অস্থিরতা। মানুষের সঙ্গ ভাল লাগে না। কারো সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছা করে না। অবশ্যি কথা বলার প্রয়োজনও আমার কমে গেছে।
আমি মানুষের মনের কথাতো বুঝতেই পারছি।
আমার ক্ষুধাবোধ, তৃষ্ণাবোধও কমে গেল। রোদে যখন দাঁড়াই আমার ভাল লাগে। খোলা প্রান্তরে দাঁড়ালে ভাল লাগে। ঘরের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসে।
আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে বিশাল এক অশ্বথ গাছ ছিল। কি কারণে জানি গাছটাকে সবাই ডাকত মান্দালের গাছ। রোজ এই গাছের কাছে যাওয়া আমার অভ্যাস হয়ে গেল। বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে গাছের কাছে যাই। সন্ধ্যা না মিলানো পর্যন্ত গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে থাকি। সন্ধ্যাবেলায় ঝাকে ঝাকে পাখি গাছে ফিরে আসে। তারা কিচির মিচির করে চারদিকে হৈ চৈ ফেলে দেয়। আমি সন্ধ্যা হওয়া দেখি, পাখিদের কিচির মিচির শুনি, এবং মাঝে মাঝে গাছের সঙ্গে কথা বলি। টবৃক্ষ জানতে চায়—তোমার মন অস্থির কেন?
জানি না কেন?
মন সুস্থির কর। অস্থিরতা কোন কাজের কথা না।
মন সুস্থীর করতে পারছি না। সব এলোমেলো লাগছে। আমাকে তোমরা এ রকম বানিয়ে দিলে কেন?
এই অবস্থাটা কি তোমার ভাল লাগছে না?
না। আমাকে আগের মতো বানিয়ে দাও।
সেটা সম্ভব না।
তাহলে পুরোপুরি গাছ বানিয়ে দাও। সেটা কি সম্ভব?
হ্যাঁ তা সম্ভব।
কোন মানুষকে কি পুরোপুরি গাছ বানানো হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে। তবে সংখ্যায় খুব কম।
তারা কি সুখী হয়েছে?
তাদের অস্থিরতা কমেছে। অস্থিরতা কমার ভেতরই সুখ। তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে—জ্ঞান বৃদ্ধিতে সুখ। তাদের ক্ষমতা অনেক অনেক বেড়েছে। ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সুখ। পরিপূর্ণ সুখ অলিক কল্পনা ছাড়া কিছুই না, একমাত্র বৃক্ষই পরিপূর্ণ সুখের কাছাকাছি বাস করে। মানুষ যে অমরত্ব চায় একমাত্র গাছের কাছেই আছে সেই অমরত্ব। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত চেতনার বিলুপ্তি ঘটে। বৃক্ষের ব্যক্তি চেতনা নেই। তার হল সমষ্টি চেতনা। সেই চেতনার মৃত্যু নেই বলেই বৃক্ষ অমরত্বের দাবী করে।
আমি না মানুষ, না বৃক্ষ হয়ে বাস করতে লাগলাম। আমার আবেগ কমে গেল। অভিভূত হবার ক্ষমতা চলে গেল। প্রবল দুঃখেও আমার চোখে পানি আসে না। প্রবল আনন্দেও উল্লাসিত বোধ করি না। বাবা আমাকে নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়লেন। প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন—তোর কি হয়েছে বলতো? অসুখটা তো মনে হয় পুরোপুরি সারে নি। শরীরের অসুখ সারলেও মনে হয় তোর মনে কোন অসুখ ঢুকে গেছে। চল ঢাকায় যাই–তোকে বড় একজন ডাক্তার দেখাই। আমি বললাম, চল।
ঢাকায় নিয়ে গিয়ে আমাকে অনেক ডাক্তার-টাক্তার দেখানো হল। তাঁরা বললেন—সমস্যা কিছু আছে। হার্টবিট স্বাভাবিকের চেয়েও বেশ কম, ব্লাড প্রেসার কম—তবে তেমন গুরুত্তর কিছু না। অনেকের হার্টবিট জন্ম থেকেই কম থাকে, প্রেসারও কম থাকে। এর বেলাতেও হয়ত তাই।
বাবা খুব দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন এবং তার পাঁচ দিনের মাথায় এক দুপুরে কোন অসুখ বিসুখ ছাড়াই হুট করে মারা গেলেন। আমার কোন রকম দুঃখ বোধ হল না। বরং মনে হল ভালই তো হয়েছে। আমার আর কোন পিছুটান থাকল না–এখন নিজের মনে ঘুরে বেড়াতে পারি যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারি।
নতুন এক ধরনের জীবন যাত্রা আমার জন্যে শুরু হল। বেশীর ভাগ সময় লোকালয়ের বাইরে থাকি মাঝে মাঝে লোকালয়ে ফিরে আসি। জীবিকার জন্যে ম্যাজিক দেখাই। ম্যাজিক দেখানোর জন্যে আমার কিছুই লাগে না। আমি মানুষকে প্রভাবিত করতে পারি। আমি হান্তে একটা মাটির দলা নিয়ে যদি মনে মনে ভাবি—এটা মাটির দলা না, এটা সুন্দর গোলাপ ফুল—সবাই সেটাকে গোলাপ ফুলই দেখে। শুধু যে দেখে তাই না, গোলাপের সৌরভও পায়।
মাঝে মাঝে আমি হতাশাগ্রস্থ হই তখন গাছরা আমাকে সান্ত্বনা দেয়। তারা বলে—সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বলি, যদি ঠিক না হয়?
তাহলে আমরা তোমাকে পুরোপুরি বৃক্ষ বানিয়ে দেব।
তোমরা আমার ভেতর তোমাদের অংশ ঢুকিয়ে দিলে কেন?
আমরা যা করেছি তোমাকে সাহায্য করার জন্য করেছি। মানবজাতি শুরু থেকে এই পর্যায়ে যে এসেছে তার প্রতিটি ধাপে আমরা তাদের সাহায্য করেছি। এখনো করছি। মানুষ তার রোগ, জড়া, ব্যাধির ওষুধ গাছ থেকে পেয়েছে। আমরা তাদের বলে দিয়েছি এই গাছের এই ফলটি ব্যবহার কর, বা শিকড় ব্যবহার কর। মানুষ ব্যবহার করেছে এবং পরে ভেবেছে এইসব আবিষ্কার সে নিজে নিজে করেছে। তাতে কিছু যায় আসে না। তোমার ব্যাপারে আমরা যা করেছি তা ছাড়া তোমাকে বাঁচানোর কোন উপায় ছিল না।
এই জীবন কি আমি চেয়েছিলাম?
অর্ধেক মানুষ। অর্ধেক গাছ। কোন কিছুর সঙ্গেই আমার যোগ নেই, আবার সব কিছুর সঙ্গেই যোগ আছে। এ এক অদ্ভুত অবস্থা।