আমি বললাম, হ্যাঁ।
নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে না?
আমি বললাম, না। কষ্ট হচ্ছে না।
খিদে পেয়েছে? কিছু খাবি?
হুঁ।
শরীরটা কী সত্যি ভাল মনে হচ্ছে?
হুঁ।
বাবা মহাবিষ্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি গাছ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাবা বললেন, একি গাছ ছেড়ে দিলি কেন?
আমি বললাম, আমি ভাল হয়ে গেছি। কথাটা যে আমি নিজে বললাম তা। আমার ভেতর থেকে অন্য কেউ যেন বলল। দীর্ঘদিন পর প্রথমবারের মতো আমি কারও সাহায্য ছাড়াই নিজে হেঁটে বাড়ি ফিরলাম। জলচৌকিতে বসিয়ে গরম পানিতে আমাকে গোসল করানো হল। রহিমা খালা বার বার বলতে লাগলেন, বড় আচানক ঘটনা। বড়ই আচানক।
আমার জন্যে আলোচালের ভাত এবং শিং মাছ রান্না করা হল। তৃপ্তি করে ভাত খেলাম। আগের মতো বমি করে ভাত উল্টে ফেলে দিলাম না।
বাবা বললেন, এখনও কি ক্লান্ত ভাব আছে?
আমি বললাম, আছে।
বাবা বললেন, চল যাই গাছ জড়িয়ে ধরে বসে থাক। একটু কষ্ট কর।
আমি বললাম, আর গাছ জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে হবে না। আমি সেরে গেছি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাব।
বাবা আমাকে শুইয়ে দিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। এমন শান্তিময় ঘুম আমি আগে কখনো ঘুমাই নি। ভবিষ্যতেও যে ঘুমাব তা মনে হয় না। যেন আমার শরীর পাখির পালকের মতো হয়ে গেছে। সেই পালক ভেসে বেড়াচ্ছে হিম হিম হাওয়ায়। সেই গভীর শান্তিময় ঘুমে আমি অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। গহীন কোনো বনের ঠিক মাঝামাঝি আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার চারপাশে গাছ। সেই গাছের শাখা প্রশাখা প্রায় আকাশ স্পর্শ করছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি স্থির হয়ে। আমার নিজেকেও একটা গাছের মতই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি তাদেরই একজন। সমস্ত বনভূমি শব্দহীন। বাতাসে গাছের পাতা কাঁপার শব্দও আসছে না। যেন সমগ্র বনভূমি কোন কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছে। কোন বিশেষ ঘটনা ঘটবে। সবাই অপেক্ষা করছে বিশেষ সেই ঘটনার জন্যে।
বিশেষ ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত ঘটল। গাছ আমার সঙ্গে কথা বলল, কোন একটি বিশেষ গাছ না—বনভূমির সব গাছই কথা বলল। প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা, তাদের চিন্তা ভাবনা আলাদা। গাছরা সে রকম না। তারা সবাই মিলে এক। তাদের সবার চিন্তা ভাবনাই এক। প্রতিটি গাছ, প্রতিটি লতা ও গুল্ম একে অন্যের অংশ। গাছরা বলল, তুমি কি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছ?
আমি বললাম, পাচ্ছি।
তুমি কি বুঝতে পারছ–এখন তুমি আমাদেরই একটা অংশ?
বুঝতে পারছি।
আমরা তোমার রোগ নিয়ে নিয়েছি।
আপনাদের ধন্যবাদ।
সেই সঙ্গে আমরা আমাদের একটা অংশও তোমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছি। এছাড়া অন্য উপায় ছিল না।
ও আচ্ছা।
এখন তুমি পুরোপুরি মানুষ নও।
আমি কি এখন গাছ?
না তুমি পাছও নয়। গাছদের চেতনার একটা অংশ তোমার মধ্যে চলে গেছে। সেটা যে খুব আনন্দময় তা-না।
ও আচ্ছা।
চেতনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তোমাকে আমাদের ক্ষমতার কিছু অংশও তোমাকে দিলাম। বলতে পার তোমার জন্যে এ হল আমাদের সামান্য উপহার।
আপনাদের কি অনেক ক্ষমতা?
হ্যাঁ আমরা মহাশক্তিধর। আমরা এই পৃথিবীর সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করি। মানুষ তা বুঝতে পারে না। তবে এখন থেকে তুমি খানিকটা বুঝতে পারবে। ভাল কথা, কিছুটা কি বুঝতে পারছ না?
পারছি।
নতুন জীবনের শুরুতে তোমার কষ্ট হবে। নিজেকে অসম্ভব নিঃসঙ্গ মনে হবে। তবে এক সময় সেই কষ্ট সহনীয় হয়ে যাবে। তাছাড়া তুমি নিঃসঙ্গ নও!
আমার মতো কি আরো অনেক আছে?
না, অনেক নেই। খুব অল্প সংখ্যকই আছে। গাছের চেতনার অংশ সবাইকে দেয়া হয় না। কাউকে কাউকে দেয়া হয়।
আমার স্বপ্ন এইখানেই শেষ হল। সাধারণত অদ্ভুত বা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখার পরপরই ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমার ঘুম ভাঙ্গল না—আমি আরো আনন্দময় ঘুমের ভুবনে তলিয়ে গেলাম। কোথায় যেন অপার্থিব সুরে গান হচ্ছে। আমি কিছু শুনতে পারছি আবার কিছু পারছি না।
পরদিন আমার ঘুম ভাঙ্গল সম্পূর্ণ নতুন মানুষ বা মানুষ না অন্যকিছু হিসেবে। শরীরে কোন রোগ নেই। কোন ক্লান্তি নেই।
বাবার সঙ্গে দেখা হতেই বাবা বললেন, কিরে তোর শরীরটা এখনও ভাল
আমি বললাম, হ্যাঁ।
বাবা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, অদ্ভুত কাও। শিউলি গাছটা মনে হয় মারা যাচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ আগে দেখে এসেছি। বেশির ভাগ পাতা হলুদ হয়ে গেছে। তোর অসুখ গাছটা সত্যি সত্যি নিয়ে নিয়েছে। জগৎ বড়ই রহস্যময়।
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে আছি। আমি বুঝতে পারছি—জগংটা বাবার কাছে যতটা রহস্যময় মনে হচ্ছে এই জগৎ তার চেয়েও অনেক অনেক রহস্যময়।
এই মুহূর্তে আমি নতুন এক রহস্যের মুখোমুখি হয়েছি। কারণ আমি বাবার মনের কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। তিনি কি ভাবছেন, না ভাবছেন তা খোলা বইয়ের মতো পড়তে পারছি। বাবা বললেন, কিরে তুই এমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? কী দেখছিস?
আমি কিছুই দেখছি না, আবার অনেক কিছুই দেখছি।
এই টগর তুই এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তোর কি শরীর খারাপ লাগছে? শরীর খারাপ লাগলে বোস।
আমি বললাম না। দাঁড়িয়েই রইলাম। এবং বাবা কি ভেবেছেন তা জানতে লাগলাম। কাজটা কি অন্যায় হচ্ছে? হয়ত হচ্ছে। বাবা ভাবছেন তার মেয়ের কথা। তাঁর সমস্ত অন্তর কাঁদছে। সেই কান্না ভয়াবহ কান্না। তিনি ভাবছেন—আহারে আজ যদি আমার মেয়েটা বেঁচে থাকত। দুই ভাই বোন মিলে কত আনন্দই না করত। তার পরপরই তিনি ভাবলেন তার প্রথম স্ত্রীর। কথা—আমার মার কথা। এই প্রথম বাবার চিন্তায় আমি আমার মা’কে স্পষ্ট দেখলাম। মার চেহারাটা তো খুব সুন্দর ছিল। তবে গায়ের রঙ কাল আমি ভেবেছিলাম, মা বোধ হয় ফর্সা ছিলেন।