হ্যাঁ।
যা হয়েছে ভালই হয়েছে। ঠিক না টগর?
হুঁ ঠিক।
চুপচাপ বারান্দায় বসে থেকে কী করবি? যা ঘুমুতে যা।
আমি ঘুমুতে গেলাম। বাবাও ঘুমুতে গেলেন। কিছুক্ষণ পরই শুনি বাবা। বিকট চিৎকার করে কাঁদছেন। আমি বললাম, কী হয়েছে বাবা? বাবা বললেন, মেয়েটা একা একা ভয় পাচ্ছে।
আমি বললাম, চল আমরা দু’জন কবরের পাশে বসে থাকি।
বাবা তৎক্ষণাৎ বিছানা থেকে নেমে বললেন, চল যাই।
আমরা দু’জন বাকি রাতটা পারুলের কবরের পাশে চুপচাপ বসে কাটিয়ে দিলাম। ভোরবেলা আমি ঘরে ফিরলাম জ্বর নিয়ে। তেমন জ্বর না, সামান্য শরীর গরম। মাথা ঝিমঝিম। সেই জ্বর আর কাটে না। এক দু’দিন ভাল থাকি আবার জ্বর আসে।
শরীর দুর্বল হতে থাকল। এক সময় চোখ ঘোলাটে হয়ে গেল। কিছুদিন পর এমন অবস্থা হল যে আমি বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারি না। কিছুই খেতে পারি না। সামান্য পানি মুখে দিলেও বমি হয়ে যায়। নানান ধরণের চিকিৎসা হতে থাকল। এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজী, ইউনানী। আধি ভৌতিক চিকিৎসাও হল। কেউ কেউ বললেন আমাকে জ্বীনে ধরেছে। সেই জ্বীন তাড়াবার ব্যবস্থাও হল। হলুদ পুড়িয়ে নাকের কাছে ধরা। শুকনো মরিচ পুড়িয়ে ধোয়া দেয়া। ভয়াবহ ব্যাপার। কোন লাভ হল না। বাবা আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। ঢাকার ডাক্তাররা অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বললেন—আমার যা হয়েছে তার নাম জন্ডিস। খুব খারাপ ধরনের জন্ডিস। হেপাটাইটিস বি। লিভার পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। ডাক্তারদের নাকি করার কিছু নেই। বাবা আমাকে দেশের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন।
এক রাতে আমার অবস্থা খুব খারাপ হল। রহিমা খালা কান্নাকাটি শুরু করলেন। আমি বাবাকে ডেকে বললাম, আমার খুবই খারাপ লাগছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। দম আটকে আসছে। তুমি আমাকে কোলে করে বারান্দায় নিয়ে যাও। খোলা বাতাসে আমি বোধ হয় নিঃশ্বাস নিতে পারব। বাবা আমাকে কোলে তুলে নিলেন। তবে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গেলেন না। বাড়ির পেছনে নিয়ে গেলেন। আমাদের বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে বড় একটা শিউলি গাছ ছিল। প্রতি বছর এই গাছে অসংখ্য ফুল ফুটতো। বাবা সরাসরি গাছের কাছে নিয়ে গেলেন এবং আমাকে অদ্ভুত একটা কথা বললেন—
বাবা বললেন, টগর তোর যে অসুখ হয়েছে সেই অসুখ সারাবার সাধ্য মানুষের নেই। আমি একটা শেষ চেষ্টা করব। অন্য রকম এক চিকিৎসা। সাধু ধরনের একজন মানুষ এই চিকিৎসায় ভাল হয়েছেন। তাঁর মুখ থেকে শোনা। সব চেষ্টাই তো করা হল—এটাও এক ধরনের চেষ্টা।
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, কী চেষ্টা?
তোকে আমি শিউলি গাছের নীচে বসিয়ে দিব। তুই দুই হাতে শক্ত করে গাছটাকে জড়িয়ে ধরে থাকবি আর মনে মনে বলবি, গাছ তুমি আমার অসুখটা তোমার নিজের শরীরে নিয়ে আমাকে সুস্থ করে দাও। পারবি না?
আমি বললাম, পারব। বাবাকে খুশি করার জন্যেই বললাম পারব।
ডুবন্তু মানুষ বাঁচার জন্যে খরকুটো ধরে। বাবাও তাই করছেন। কিছু না পেয়ে গাছের হাতে আমাকে তুলে দিচ্ছেন। বাবা যে ভাবে গাছ ধরতে বললেন, সেই ভাবে ধরলাম এবং মনে মনে বললাম, হে গাছ তুমি আমার রোগ তোমার নিজের শরীরে নিয়ে আমাকে সুস্থ করে দাও।
বাবা বললেন, টগর। তোকে এই যে আমি গাছের সঙ্গে জুড়ে দিলাম আর তুলব না। তুই খুব মন লাগিয়ে গাছকে বল তোকে সারিয়ে দিতে।
আমি গাছ জড়িয়ে ধরে বসে আছি। আমার অসম্ভব দুর্বল শরীরে কিছু না ধারে বসে থাকাও সম্ভব না। আমি যা করছি তা যে খুব অস্বাভাবিক কিছু তাও মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যা করছি, ঠিকই করছি।
রহিমা খালা বাবাকে বললেন—আপনের কি মাথাটা খারাপ হইছে? আপনে করতাছেন কী? এইটা কেমন চিকিৎসা? অসুখ হইছে পুলার। মাথা খারাপ হইছে আপনের।
বাবা বললেন, তুমি কথা বলবে না রহিমার মা। একটা কথাও না।
এই অবস্থায় কতক্ষণ থাকব?
জানি না।
আমার অসুখ এই পর্যায়ের ছিল যে আমি বেশির ভাগ সময়ই ঘোরের মধ্যে থাকতাম। চারপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে বুঝতে পারতাম না।
গাছ জড়িয়ে ধরার পর পরই আমি ঘোরর মধ্যে চলে গেলাম। প্রবল ঘোর। মাঝে মাঝে ঘোর কমে, আমি আবছা ভাবে দেখি বাবা পাশেই বসে আছেন। আমি যতবারই চোখ মেলি ততবারই বাবা বললেন—কথা বল। গাছের সঙ্গে কথা বল।
আমি ফিস ফিস করে বলি—হে গাছ তুমি আমার রোগ তোমার শরীরে নিয়ে আমাকে সারিয়ে দাও। হে গাছ তুমি আমার রোগ তোমার শরীরে নিয়ে আমাকে সারিয়ে দাও। হে গাছ তুমি…
ভীর রাতে গাছের সঙ্গে
বাবা আমাকে গভীর রাতে গাছের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন। রাত কেটে ভোর হল আমি সেইভাবেই রইলাম। বেলা বাড়তে থাকল। এক সময় মাথায় রোদ এসে পড়ল—আমি নড়লাম না। আমার সময় কাটতে লাগল প্রবল ঘোর এবং প্রবল অবসাদের মধ্যে। আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেই বোধ ক্রমেই লুপ্ত হতে থাকল। কেউ যেন আমাকে আমার চেনা জগৎ থেকে খুব ধীরে ধীরে আলাদা করে নিচ্ছে। আমি প্রবেশ করছি অন্য এক ভুবনে। সেই ভুবন ছায়াময়, আনন্দময় এবং নিস্তরঙ্গ জলের মতো শান্ত। সেই জলে ছায়া পড়ে, কিন্তু ছায়া স্থায়ী হয় না। একটা ছায়া মিলিয়ে যায় অন্য ছায়া আসে। নিস্তরঙ্গ জলে চলমান গতিময়। জীবন।
এক সময় আমি চোখ মেললাম, দেখলাম সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আকাশে শেষ সূর্যের আলো। আমি গাছ জড়িয়ে ধরে বসে আছি। বাবা আমার পাশেই। তার মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, টগর শরীরটা কী একটু ভাল লাগছে?