এক সময় লক্ষ্য করলাম পারুলের বেশিরভাগ প্রশ্নেরই আমি জবাব দিতে পারছি না। তার প্রশ্নগুলি ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
অগর ভাইয়া তুমি প্রায়ই বল চাঁদের আলো সুন্দর। তা হলে কি সূর্যের আলো অসুন্দর?
অসুন্দর না তবে চাদের আলো বেশি সুন্দর। চাঁদের আলো নরম।
আলোর ভেতর নরম আর শক্ত কী? তুমি তো আর আলো হাত দিয়ে ধরতে পারছ না।
কথার কথা বললাম।
সূর্যের আলো গায়ে লাগলে আমি বুঝতে পারি। চাঁদের আলো বুঝতে পারি কেন?
ঐ যে বললাম চাঁদের আলো খুব হালকা।
হালকা বলছ কেন? আলোর কি ওজন আছে?
পারুল আমি বুঝতে পারছি না।
তুমি একবার বলেছি পৃথিবীতে সব মিলিয়ে মাত্র সাতটা রঙ। আসলেই কি তাই?
হ্যাঁ সাতটা রঙ। তবে একটা রঙের সঙ্গে অন্য রঙ মিলে নতুন রঙ তৈরি হয়।
বুঝতে পারছি না।
চিনি সঙ্গে যদি সামান্য লবন মেশানো হয় তাহলে খাবারে যমেওন মিষ্টি স্বাদ থাকে তার সঙ্গে সঙ্গে একটু লোনা স্বাদও থাকে। অনেকটা এ রকম?
তার মানে কি এই যে পৃথিবীতে রঙের কোনো সীমা নেই?
হ্যাঁ তাই।
আরো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বল আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আমি তাকে বুঝাতে পারি। আমি নিজে যেমন হতাশ হই—পারুল তার চেয়ে বেশি হতাশ হয়। সে প্রাণপণে চেষ্টা করে তার হতাশা চেপে রাখার। সেই চেষ্টা ফলবতী হয় না।
পারুল যতই বড় হতে থাকল তার ভেতর থেকে হাসি খুশি ভাব ততই কমে যেতে লাগল। এবং তার প্রশ্নগুলিও ততই অদ্ভুত হতে লাগল। যেমন সে একদিন জিজ্ঞেস করল–
অগর ভাইয়া একটা মেয়ে যখন একটা ছেলেকে পছন্দ করে—মানে এই ইয়ে ধর ভালবাসে তখন কি সেই ভালবাসারও রঙ আছে?
না।
না কেন? সব কিছুর রঙ আছে ভালবাসার রঙ থাকবে না কেন? থাকতেই হবে। ভালবাসার খুব সুন্দর রঙ থাকবে। ঘৃণার থাকবে কুৎসিত রঙ। অবহেলার এক রকম রঙ আবার অভিমানের অন্য রকম রঙ।
আমি হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকি। পারুল প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যায়। মনে হয়ে সে যেন রেগে যাচ্ছে।
আচ্ছা আবেগের কোন রঙ নেই?
শব্দের? শব্দের কী কোন রঙ আছে?
গাছের পাতা যখন বাতাসে কাঁপে তখন কি তার রঙ বদলে যায়?
পারুল গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বলে—আমার মনে হয় শব্দের রঙ আছে। তোমরা ভালমত দেখতে পার না বলে বুঝতে পার না। বৃষ্টি পড়ার শব্দের এক রকমের রঙ, আবার পাখি যখন ডাকল তখন আরেক রকম রঙ। মুরগি যখন জবাই করার আগে চিৎকার করতে থাকে তখন তার চিৎকারের এক রকম রঙ। আবার স্বাভাবিক অবস্থায় যে যখন ডাকে তখন অন্য রকম রঙ।
আমি চুপ করে যাই পরুলও চুপ করে যায়। এবং একটা সময় আসে যখন এ জাতীয় কথাবার্তা সে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। বেশির ভাগ সময় সে কাটাতে থাকে আমাদের বাড়ির পেছনের পুকুর পাড়ে। আমি দূর থেকে লক্ষ্য করি সে পুকুরের পাড় ঘেসে হাঁটে আর আপন মনে কথা বলে।
বাবা একদিন বললেন, মেয়েটার হল কী বলতো? পাগল হয়ে গেল নাকি? পুকুরের চারদিকে শুধু চক্কর দেয়। পুকুরটা কি কাবা শরীফ যে তার চারপাশে চক্কর দিতে হবে? নিষেধ করিস তো। কোন দিন পা পিছলে পুকুরে পড়বে। সাঁতার জানে না। একসিডেন্ট করবে।
বাবার কথা একদিন ফলে গেল। পারুল পা পিছলে পুকুরে পড়ে গেল। আমরা কেউ তা জানতেও পারলাম না। আমরা জানলাম দুপুরের পর যখন পারুল পুকুরে ভেসে উঠছে।
পারুল পা পিছলে পুকুরে পড়েছিল না-কি নিজে ইচ্ছা করে পুকুরে নেমে গিয়েছিল এ বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। দৃষ্টিহীন মানুষ অসম্ভব সাবধানী হয়। কলার খোসায় পা পিছলে সাধারণ মানুষ পড়ে, দৃষ্টিহীন মানুষরা পড়ে না। তাছাড়া পুকুর পাড়ের মাটির প্রতিটি ইঞ্চি পারুলের পরিচিত। সে তার ক্ষুদ্র জীবনে খুব কম করে হলেও এক লক্ষবার পুকুরের চারদিকে হেঁটে ফেলেছে।
যে রাতে পারুল মারা যায় তার আগের রাতে আমার সঙ্গে সে যে সব কথা বলেছে তার থেকেও খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আমরা দুজন রাতের খাবার খাচ্ছি—বাবা বাইরে। তিনি রাতেই ফিরবেন, কিন্তু ফিরতে দেরি হবে। পারুল ভাত মাখতে মাখতে হালকা বলল, অগর ভাইয়া মৃত্যুর আগে আগে অন্ধ মানুষ নাকি চোখে দেখতে পায়। বধিরও কানে শুনতে পায়? কথাটা কি সত্যি?
আমি বললাম, কে বলেছে?
রহিমা খালা বলেছে।
ঠিক বলেনি।
পারুল গম্ভীর গলায় বলল, আমার মনে হয় ঠিকই বলেছি। মৃত্যুর আগে শেষবারের মত মানুষ প্রাণ ভরে পৃথিবী দেখবে এটাই স্বাভাবিক। বুঝলে ভাইয়া আমি আর কিছু চাই না শুধু একবারের মত রঙ ব্যাপারটা কী দেখতে চাই।
আমি নিজে মনে করি পারুল মারা গেছে–রঙ কী সেটা একবারের জন্যে হলে ও দেখতে গিয়ে। আমার এই ধারণার কথা আমি বাবাকে বলিনি। বললে তিনি খুব কষ্ট পেতেন।
পারুলের মৃত্যুর পর বাবা এমন ভাব করলেন যেন তিনি খুশি হয়েছেন। পারুলকে কবর দেয়া হল পুকুর পাড়ে। কবর দেয়ার পরে বাবা আর আমি চুপচাপ বারান্দায় বসে আছি। বাবা বললেন—ভালই হয়েছে বুঝলি উগর। মেয়েটা মরে গিয়ে বেঁচেছে। আমি আসলে খুশিই হয়েছি। আই এম এ হ্যাপী ম্যান। মেয়েটার বিয়ে দিতে পারতাম না, কষ্টে কষ্টে জীবন কাটত। তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
আমি যতদিন থাকতাম মেয়েটাকে দেখতাম। তারপর আমি যখন মারা যেতাম তখন কী হত? তুই থাকতি তোর নিজের সংসারে নিয়ে। পারুল তোর সঙ্গে থাকলে তোর বৌ হয়ত সেটা পছন্দ করত না। ঠিক না?