সে না সূচক মাথা নাড়ল।
মবিন উদ্দিন বললেন, তোমাকে আমার একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। জিজ্ঞেস করলে জবাব দেবে?
জ্বি দেব।
আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমি আব্দুল মজিদের মনের কথা বুঝতে পারছি—এটা কি সত্যি।
জ্বি সত্যি।
এটা কীভাবে সত্যি হয়?
আমি আপনাকে সাহায্য করেছি।
তুমি এইসব শিখলে কীভাবে?
আমি একটা খাতায় আমার ব্যাপারটা লিখেছি। খাতাটা আপনাকে দিয়ে যাব। আপনি পড়বেন। পড়া শেষ হলে খাতাটা নষ্ট করে ফেলবেন।
মবিন উদ্দিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমাকে আমি খুবই পছন্দ করি। কিন্তু এইসব ব্যাপার আমার ভাল লাগে না। মানুষ হবে সহজ, সরল স্বাভাবিক—এইসব কী?
আমার দুর্ভাগ্য যে আমি অন্য রকম হয়ে গেছি।
কীভাবে হলে?
আমি সব লিখেছি। পড়লেই আপনার কাছে পরিষ্কার হবে। আমি চলে যাচ্ছি, আপনি পড়ন। আজ রাতেই পড়ুন।
তুমি চলে যাচ্ছ তার মানে কি! কোথায় যাচ্ছ?
বুঝতে পারছি না কোথায় যাচ্ছি। আপনার কাছে আমার একটা ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারও আছে। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।
মবিন উদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি কী করেছ যে তোমাকে ক্ষমা করতে হবে?
আমি নিজেকে আপনার ছেলের মতো করে উপস্থিত করেছি। তার চেহারা তার গলার স্বর অনুকরণ করেছি। এমন কি নিজের নামও বলেছি টুনু। আমি এই ব্যাপারগুলি করতে পারি। আমার অনেক ক্ষমতা।
তুমি কি এখনি চলে যাচ্ছ? তুমি যে ভঙ্গিতে কথা বলছ তাতে সে রকমই মনে হচ্ছে।
জ্বি আমি এখনি চলে যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।
সুপ্তি আর তার মার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যাবে?
জ্বি।
তোমার কষ্ট হবে না? মন খারাপ করবে না?
আমি অর্ধেক বৃক্ষ, মানুষের আবেগ আমার নেই। আপনি যে স্নেহ করেছেন—সেই স্নেহ অপাত্রে করেছেন।
মবিন উদ্দিন আগে লক্ষ্য করেন নি, এখন লক্ষ্য করলেন ঠিক যে পোষাকে কাল যাদুকর এই বাড়িতে ঢুকেছিল সে সেই পোষাকেই পরে আছে। পাতলা একটা শার্ট, খালি পা। কাঁধে ছেড়া সুতা ওঠা কাপড়ের ব্যাগ। টুনুর মুখের কোন আদল তার মুখে এখন আর নেই। নিগ্রোদের চুলের মতো ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল। চোখের শাদা অংশ অতিরিক্ত শাদা। মনে হয় অন্ধকারে জ্বলছে।
মবিন উদ্দিন হতভম্ব গলায় বললেন, তোমার নাম কী?
এখন আমার কোন নাম নেই। তবে এক সময় সুন্দর একটা নাম ছিল।
সেই নামটা কী?
টগর।
কালো যাদুকর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল। একবারও বলল না—আপনারা আমাকে পুত্র স্নেহে রেখে দিলেন। এই স্নেহের ঋণ আমি স্বীকার করছি।
সে এমনভাবে ঘর থেকে বের হল যেন কারো কাছেই তার কোন ঋণ নেই।
অদ্ভুত একটা গল্প
আমি আমার জীবনের অদ্ভুত একটা গল্প লিখছি। যারা গল্পটি পড়বেন তাদের যে বিশ্বাস করতে হবে এমন না। বিশ্বাস করার কোন দরকার নেই। আবার অবিশ্বাস করারও দরকার নেই। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝিটা করলেই হল। আমরা সব সময় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি জগতে বাস করি। কে জানে হয়ত এই জগতই সত্যি।
আমার মা খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। মা’র কোন স্মৃতি আমার মনে নেই। শুধু একটা স্মৃতি আছে—আমি একটা জলচৌকিতে উবু হয়ে বসে আছি, মা আমার মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালছেন—আমার প্রচন্ড শীত লাগছে। আমি শীতে কাপছি। মাথায় পানি ঢালার সময় মা’র হাতের কাচের চুড়িতে টুন টুন শব্দ হচ্ছে। আমার কাছে মা’র স্মৃতি হচ্ছে—ঠান্ডা পানি ঢালার শব্দ, চুড়ির টুন টুন শব্দ। ব্যাস এই পর্যন্তই, মা’র চেহারার কোনো স্মৃতি আমার নেই। তিনি দেখতে কেমন ছিলেন? তাঁর কি মায়া মায়া চোখ ছিল? তিনি কি পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রাখতেন? কিছু জানি না।
মা’র মৃত্যুর দু’বছর পর বাবা আবার বিয়ে করেন। নতুন মা’র কথা আমার খুব মনে আছে।
নতুন মা’র চেহারা খুব সুন্দর ছিল। তিনি হাসি খুশি ধরনের ছিলেন। স্বভাবটা ছিল ছটফটে ধরনের। অনেকটা চুড়ই পাখির মত। কোথাও বেশিক্ষণ স্থির হয়ে থাকতে পারতেন না। নতুন মা আমাকে খুব আদর করতেন। আসল মা’র আদর কেমন তাতো জানি না নতুন মা’র আদর পেয়েই আমার আনন্দের সীমা ছিল না। তিনি আমাকে গ্রহণ করেছিলেন—বন্ধু হিসেবে, খেলার সাথী হিসেবে। নতুন মা’র বয়স অল্প ছিল। তার খেলার সঙ্গীর প্রয়োজন ছিল। আমার বাল্যকাল এবং কৈশোর কেটেছে খুবই সুখে। আমার সুখ স্থায়ী হল না। আমার যখন তের বছর বয়স তখন নতুন মা মারা গেলেন।
নিজের মা’র মৃত্যুতে আমি কষ্ট পাইনি। নতুন মা’র মৃত্যুতে আমি প্রথম কষ্ট পেলাম। নতুন মাও সম্ভবত অন্য ভূবনে যাত্রার আগে আমার কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছিলেন। কারণ তিনি মৃত্যুর আগে আগে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন– আহারে আমি চইল্যা গেলে আমার টগররে কে দেখব?
তখন তার নিজের একটি মেয়ে আছে। তারও ফুলের নামে নাম—পারুল। খুবই আশ্চর্যের কথা একবারও তিনি তাঁর মেয়ের কথা বললেন না। একবারও বললেন না, আমার পারুলরে কে দেখব? তিনি কাঁদতে লাগলেন আমার কথা ভেবে।
মা’র মৃত্যুর পর বাবা আমাকে ডেকে বললেন–বুঝলি টগর, আমার কপালে সংসার নেই। বিয়েদী আর করব না। তোর ছোট বোনটাকে তো বড় করা লাগবে—দুইজনে মিলে পারব না?
আমি বললাম, পারব।
বাবা বললেন, শিশু মানুষ করা কঠিন ব্যাপার। দুইজনে মিলে এই কঠিন কাজটা সমাধা করতে হবে। উপায় কী? তবে মেয়ে তো, একটু বড় হলে দেখবি আমাদের আর তাকে পালতে হচ্ছে না উল্টা সেই আমাদের পালছে। কয়েকটা বছর ধৈর্য ধরে তার বোনটাকে বড় করতে হবে। আগের মতো আর বাইরে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। বেশির ভাগ সময় এখন ঘরেই থাকতে হবে।