ম্যাজিশিয়ান হাসতে হাসতে বলল, আমার নেই।
মবিন উদ্দিন বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমার থাকবে না কেন? তুমি তো। আকাশ থেকে নামনি। না-কি আকাশ থেকে নেমেছ?
ম্যাজিশিয়ান এখনও হাসছে।
দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে কেউ কড়া নাড়ছে। কে এসেছে? সুরমা ফিরে এসেছে না-কী? বারহাট্টা থেকে এখন আসার কোন ট্রেন নেই—তবে বাসে করে চলে আসতে পারে। সুরমা বাবার বাড়িতে পৌঁছেই হয়ত বুঝতে পেরেছে সে কাজটা ভাল করেনি। তারপর বাসে করে চলে এসেছে। তবে ম্যাজিশিয়ান বলছিল তারা কাল-পরশু আসবে। ম্যাজিশিয়ানের কথাতো ভুল হবে
মবিন উদ্দিন ম্যাজিশিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন, কে এসেছে?
ম্যাজিশিয়ান সঙ্গে সঙ্গে বলল, আপনার বোনের স্বামী মজিদ সাহেব এসেছেন। মবিন উদ্দিন ম্যাজিশিয়ানের চোখে মুখে সুক্ষ্ম হাসি লক্ষ্য করলেন। ম্যাজিশিয়ানরা বড় ধরনের কোন ম্যাজিক দেখাবার আগে আগে যে বিশেষ ভঙ্গিতে হাসে। সেই ভঙ্গির হাসি।
মবিন উদ্দিন তীব্র গলায় বললেন, না দেখে বলে ফেললে? তারপরেও বলতে চাও তুমি যাদুবিদ্যা জান না?
মবিন উদ্দিন দরজা খুললেন। হ্যাঁ আব্দুল মজিদই এসেছে। সে অন্যদিনের মতোই হাসিখুশি। তার মুখ উজ্জ্বল। হাতে মিষ্টির হাড়ি।
কী খবর আব্দুল মজিদ?
জি খবর ভাল।
হাতে কী?
রসোগোল্লা। সুপ্তির জন্যে এনেছি। নিধু সাহার কাপড়ের দোকানে এসেছিলাম, ভাবলাম আপনাদের খোঁজ নিয়ে যাই। চায়েরও পিপাসা পেয়েছে। এক কাপ চা খেয়ে যাই।
চা খাওয়াতে পারব না। সুরমা-সুপ্তি কেউ বাসায় নাই।
সে-কী! ওরা কোথায়?
বারহাট্টা গিয়েছে।
সঙ্গে কে গিয়েছে, ম্যাজিশিয়ান ছেলেটা? ভাইজান আপনি নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনছেন। ছেলেটাকে এখনও তাড়ান নাই?
ওই প্রসঙ্গ বাদ দাও।
বাদ দিব কেন? বাদ দেয়ার মতো বিষয় তো না। শেষ পর্যন্ত একটা কেলেংকারী হবে।
যখন হবে তখন দেখা যাবে। তুমি কি কোন কাজে এসেছ না এমি এসেছ?
আব্দুল মজিদ বসতে বসতে বলল, একটা কাজেই এসেছি। বুঝলেন ভাইজান ওইদিন টাকাটা গুণে না নিয়ে ভুল করেছি। গুণে নেয়ার দরকার ছিল।
মবিন উদ্দিন হতভম্ব হয়ে বললেন, সে-কী টাকা কম ছিল না-কী?
আব্দুল মজিদ হাসতে হাসতে বলল, জ্বি না। একটা পাঁচশ টাকার নোট বেশি ছিল। ব্যাংকও মাঝে মাঝে ভুল করে। নোর্টটা নিয়ে এসেছি।
আব্দুল মজিদ মানিব্যাগ বের করল আর তখন ঠিক আগের বারের মতো আব্দুল মজিদ কী ভাবছে তিনি বুঝতে পারলেন। আব্দুল মজিদ ভাবছে টাকা ঠিকই ছিল তারপরেও পাঁচশ টাকা দিচ্ছি বুঝানোর জন্যে যে আমি মানুষটা অতি সৎ। আমার মধ্যে কোন অসৎ ব্যাপার নাই।
মবিন উদ্দিন বললেন, সত্যি সত্যি পাঁচশ টাকা ছিল?
জ্বি ছিল।
মবিন উদ্দিন টাকাটা হাতে নিলেন। মনে মনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি কি আসলেই আব্দুল মজিদের মনের কথা বুঝতে পারছেন, না এটাও তার কল্পনা।
ভাইজান একটা বিষয় শুনে খুবই মনে কষ্ট পেয়েছি।
বিষয়টা কী?
শুনলাম আপনি না-কি দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন।
হ্যাঁ।
আমাকে টাকা দেয়ার জন্যে দোকান বিক্রি করতে হল? ছি ছি।
না ছি ছি কিছু না। এম্নিতেও বিক্রি বাটা হচ্ছিল না।
এখন কী করবেন বলে ঠিক করেছেন?
গ্রামের বাড়িতে চলে যাব বলে ঠিক করেছি। কিছু ধানী জমি আছে। পুকুর আছে। শহরের এই বাড়ি বিক্রি করলে কিছু টাকা পাব।
বুদ্ধিটা খারাপ না ভাইজান। পুকুরে যদি মাছের চাষ করেন—ভাল আয় হবে। আর আপনারা তিনজন মোটে মানুষ–আপনাদের আর খরচ কী?
মবিন উদ্দিন কিছু বললেন না। এই আলোচনা চালিয়ে যেতে তাঁর ইচ্ছা করছে না।
পুকুরে গ্রাস কার্প ছাড়বেন, সিলভার কাপ ছাড়বেন, সরপুটিও ভাল হয়। ফিসারী ডিপার্টমেন্টের এক অফিসারের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। নিয়ে আসব আপনার কাছে।
আচ্ছা।
মাছের চাষে অভিজ্ঞতা আছে এমন একজন কর্মচারী রেখে দেবেন। আছে, আমার জানামতে বিশ্বাসী লোক আছে। হ্যাচারীতে কাজ করেছে। ওকে নিয়ে আসব।
মবিন উদ্দিন ভেবে পেলেন না, তার মাছের চাষ নিয়ে আব্দুল মজিদ এত উৎসাহী কেন? রহস্যটা কী? রহস্য কিছু নিশ্চয়ই আছে কিন্তু তিনি ধরতে পারছেন না।
হঠাৎ রহস্য পরিষ্কার হয়ে গেল। আব্দুল মজিদ কি ভাবছে তিনি বুঝতে পারছেন। আব্দুল মজিদ এসেছে বাড়িটা কিনে নিতে। শহরের উপর ভাল জায়গায় বাড়ি। চারতলা দালান তুলে ভাড়া দিলে ভাল টাকা আসবে।
ভাইজান! বিল।
দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন শুনে খুবই কষ্ট পেয়েছি। হুট করে বিক্রি করলেন, দামও তো ভাল পান নি।
তা ঠিক দাম ভাল পাই নি।
বাড়ি বিক্রি করার সময় তাড়াহুড়া করবেন না। আমাকে আগে জানাবেন।
তুমি কিনতে চাও? তুমি তো বলছিলে তোমার টাকা পয়সার সমস্যা।
সমস্যা তো আছেই। সমস্যা যাই থাকুক জোগাড় করব। আপনি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তা ঠিক না। বাড়ি কবে-নাগদে বিক্রি করার কথা ভাবছেন?
এখনও এই বিষয়ে কিছু ভাবি নি।
দেরী করা ঠিক হবে না। দেরী করা মানে জমা টাকা খরচ করা। তাড়াতাড়ি ডিসিসান নিয়ে কাজ কর্ম শুরু করে দেয়া দরকার। আমি কালপরশুর মধ্যে হ্যাচারীর লোকের সঙ্গে কথা বলব। আপনার একটা ভাল ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত মনে শান্তি পাচ্ছি না ভাইজান।
ও আচ্ছা।
ভাইজান আমি আজ তাহলে উঠি?
মর্কিন উদ্দিন আব্দুল মজিদকে বিদায় দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। ম্যাজিশিয়ান ছেলেটা ঠিক আগের জায়গাতেই বসে আছে। তাকে এখন লাগছে পাথরের মূর্তির মতো। মবিন উদ্দিনকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। মবিন উদ্দিন বললেন, তুমি কি কিছু বলবে?