ছিল না।
ছিল না, তাহলে জানাওনি কেন?
সুপ্তি কোথায়?
সুপ্তি কোথায় জিজ্ঞেস করছ কেন? আমার প্রশ্নের জবাব দাও। তুমি আমাকে কখনো কিছু জানাও না কেন?
মবিন উদ্দিন চুপ করে রইলেন। সুরমা বললেন, এখন আমরা খাব কী? বাঁচব কীভাবে কিছু ভেবেছ?
মবিন উদ্দিন চুপ করে রইলেন। সুরমার কঠিন আক্রমণ সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। সুপ্তি থাকলে ভাল হত। সে বাবাকে রক্ষা করার চেষ্টা করত। মবিন উদ্দিন অসহায় বোধ করছেন।
সুরমা শান্ত গলায় বললেন, শোন আমি আজ বিকেলের ট্রেনে বারহাট্টা যাব। সুপ্তিকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
মবিন উদ্দিন বললেন, আচ্ছা।
এখন স্ত্রীর প্রতিটি কথায় রাজি হওয়াই হবে সর্বোত্তম পন্থা। বারহাট্টা তার শ্বশুরবাড়ি। সুরমা যদি সুপ্তিকে নিয়ে কয়েকদিন তার বাবা-মার কাছে যেয়ে থেকে আসে সেটা ভালই হবে। তার রাগ কমবে। তিনিও নিরিবিলি কিছুদিন ভাবার সময় পাবেন। চিন্তা-ভাবনার জন্যে তাকে আর রোজ রোজ স্টেশনে যেতে হবে না।
সুরমা তীব্র গলায় বললেন, মানুষকে তুমি মানুষ মনে কর না। মানুষকে ভাব—’গাছ’।
মবিন উদ্দিন মনে মনে বললেন, গাছকে এত তুচ্ছ মনে করো না। গাছ ভয়াবহ ব্যাপার। শুধু আমিই মানুষকে গাছ ভাবি না। অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদের গাছ ভাবে। উদাহরণের জন্যে দূরে যেতে হবে না। উদাহরণ ঘরেই আছে।
মুখ ভোতা করে থাকবে না। ভাত খাও। আমার কাজ-কর্ম আছে জিনিসপত্র গুছাতে হবে।
সত্যি সত্যি যাবে?
আমি কি তোমার সঙ্গে তামাশা করছি। তুমি কি আমার দুলাভাই?
বাবলু কোথায়?
ও ঘরেই আছে। কেন ওকে দরকার কেন?
এম্নি জিজ্ঞেস করলাম। কোন দরকার নেই।
দরকার তো থাকবেই না। কাউকেই তোমার দরকার নেই। তুমি একাই একশ। তুমি তো মহামানব।
মবিন উদ্দিন একা একা খেলেন। এবং যথারীতি শুয়ে পড়লেন। দোকান বিক্রির খবরটা যে তাকে বলতে হয়নি সুরমা নিজে নিজেই বের করেছেন এতে তাঁর ভালই লাগছে। আল্লাহ্ যা করেন ভালই করেন।
মবিন উদ্দিন চোখ বন্ধ করে আছেন। সুপ্তির সঙ্গে তাঁর মা’র কথা-বার্তা কানে আসছে।
আমরা কোথায় যাচ্ছি মা? নানার বাড়ি?
একবার তো বললাম। আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?
হঠাৎ যাচ্ছি কেন?
কাজ আছে তাই হঠাৎ যাচ্ছি।
আমার স্কুল খোলা মা।
থাকুক স্কুল খোলা। অন্ধ মেয়ে তার আবার স্কুল স্কুল খেলা।
এমন বিশ্রী করে কথা বলছ কেন?
মিষ্টি কথা শুনতে চাস? যা তোর বাবার কাছে। সে মিষ্টি কথা বলবে।
আমাদের সঙ্গে আর কে যাচ্ছে?
আমি আর তুই।
সে-কী! বাবা যাবে না? গাছ ভাইয়া যাবে না?
সুরমা কী জবাব দিলেন, মবিন উদ্দিন ধরতে পারলেন না। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছে ওরা আসলে যাবে না। বিকেল আসতে আসতে সুরমার রাগ পড়ে যাবে। সুপ্তি বাবাকে ছাড়া কোথাও যাবে না বলে বেঁকে বসবে। সব মিলিয়ে যাওয়া বাতিল হয়ে যাবে। মবিন উদ্দিন ঘুমিয়ে পড়লেন। অনেক দিন পর তাঁর গাঢ় ঘুম হল।
ঘুম ভাঙ্গল সন্ধ্যাবেলা। ঘর অন্ধকার। কারো কোনো সাড়া-শব্দ নেই। তিনি ডাকলেন——সুপ্তি। সুপ্তি। কেউ সাড়া দিল না। তিনি বিস্মিত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দেখেন ভেতরের বারান্দায় মোড়ার উপর ম্যাজিশিয়ান বসে আছে।
ওরা কোথায়?
বারহাট্টা গিয়েছে।
বারহাট্টা গিয়েছে মানে? কখন গেল?
বিকালের ট্রেনে।
তুমি কী বল? সুপ্তি আমাকে কিছু না জানিয়েই চলে গেল?
আপনি ঘুমাচ্ছেন এই জন্যে মনে হয় জাগায়নি।
কবে আসবে কিছু বলে গেছে?
না।
মবিন উদ্দিন হতভম্ব হয়ে গেলেন। যত রাগই করুক সুরমা তাকে কিছু না বলে চলে যেতে পারল?
ম্যাজিশিয়ান বলল, ওরা কাল পরশু চলে আসবে। আপনি দুঃশ্চিন্তা করবেন না।
কাল পরশু চলে আসবে তোমাকে বলে গেছে?
জ্বি না। কিন্তু আমি জানি চলে আসবে।
কীভাবে জান?
ম্যাজিশিয়ান চুপ করে রইল। মবিন উদ্দিন লক্ষ্য করলেন তিনি রেগে যাচ্ছেন। স্ত্রী কন্যার উপরের রাগটা ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার দিকে চলে যাচ্ছে।
চুপ করে আছ কেন? বল কীভাবে জান? না বলতে কোনো অসুবিধা আছে?
জ্বি-না বলতে অসুবিধা নেই।
শোন–তোমার ব্যাপার-স্যাপার আমার ভাল লাগে না। তুমি যা জান তার নাম ম্যাজিক না, তার নাম যাদুবিদ্যা। যাদুবিদ্যা ভাল জিনিস না। যাদুবিদ্যা খারাপ বিদ্যা। এই বিদ্যার চর্চা করাও খারাপ। ধর্মে নিষেধ আছে।
আমি কোনো যাদুবিদ্যা জানি না।
ফালতু কথা বলবে না। অবশ্যই তুমি যাদুবিদ্যা জান? তুমি সুপ্তিকে বলেছ। তুমি গাছ? বল নাই?
জ্বি বলেছি।
কী জন্যে বলেছ? ঠাট্টা করে বলেছ?
ঠাট্টা করে বলিনি।
তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ তুমি গাছ?
ম্যাজিশিয়ান কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে আছে। মবিন উদ্দিন চাপা গলায় বললেন, আচ্ছা যাও স্বীকার করলাম তুমি গাছ। গাছ কেন সেটা বল।
এক দুই কথায় বলা যাবে না।
এক দুই কথায় বলা না গেলে বেশি কথাতেই বল! আরেকটা কথা…
মবিন উদ্দিনের কথা বলার আগেই ম্যাজিশিয়ান বলল, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি জানি। আপনি বলতে চাচ্ছেন–আমি যেন চলে যাই।
তুমি ঠিকই ধরেছ। আমি তাই চাই।
জ্বি আমি চলে যাব।
তুমি যাবে কোথায়?
ঠিক করিনি কিছু।
দেশের বাড়িতে চলে যাও। পথে পথে ঘুরবে কেন? বাবা মার কাছে যাও।
বাবা-মা নেই।
বাবা-মা না থাকলেও আত্মীয়-স্বজন তো আছে। তাদের কাছে যাও। এমন তো না যে তোমার কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। পথে পথে ঘুরে যে ফকির তারও চল্লিশটা আত্মীয় থাকে।