রেল স্টেশনে বসে তিনি ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার কথাই বেশি ভাবেন। ব্যাপারটা কী? সে কে? তার যে কিছু কিছু ক্ষমতা আছে সে সম্পর্কে তিনি মোটামুটি নিশ্চিত। আবার কিছু ব্যাপারে নিশ্চিত না। ছেলেটাকে পুরোপুরি বিদেয় করে দেবার আগে তিনি সেইসব ব্যাপার জেনে নেবেন। কী জিজ্ঞেস করবেন কীভাবে করবেন–তিনি সেইসব ব্যাপার ভাবার চেষ্টা করেন। প্রশ্নগুলি গুছিয়ে রাখেন।
তিনি ঠিক করেছেন যাদুকর ছেলেটাকে নিয়ে এক সকালে রেল স্টেশনে আসবেন। তাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন তা বাড়ির কাউকে বলবেন না। রেল স্টেশনে এনে এই বেঞ্চিতে বসাবেন এবং নরম গলায় বলবেন—বাবা শোন। তোমাকে আমরা সবাই খুব পছন্দ করি। তুমি তা ভালই জান–এখনকথা হচ্ছে কী…
বাকিটা বলার দরকার পড়বেনা, সেই ছেলে অবশ্যই বুঝে ফেলবে। সে নিজ থেকেই বলবে–আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি। তখন তিনি তার জন্যে একটা টিকিট কেটে আনবেন। ময়মনসিংহ যেতে চাইলে ময়মনসিংহের টিকেট, ঢাকা যেতে চাইলে ঢাকার টিকিট। তারপর তাকে ট্রেনে তুলে দেবেন। কিছু টাকাও তার হাতে দিয়ে দেবেন। হাজারখানেক টাকা। আরো বেশি দিতেন, কিন্তু তাঁর সামর্থ নেই।
ছেলেটাকে কিছু জিজ্ঞস করা বোধ ঠিক হবে না। সে বিব্রত হবে। যাবার মুহূর্তে তাকে বিব্রত করে কী লাভ? যদিও তাঁর অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে। বিশেষ করে গাছের ব্যাপারটা। সে নিজেকে গাছ বলে কেন? এটা কি কোন ধরনের ঠাট্টা। না-কি সে সত্যি সত্যি গাছে? তা কী করে হয়? মানুষ গাছ হবে কীভাবে?
একদিন তিনি বারান্দায় বসে আছেন হঠাৎ শুনলেন, সুপ্তি ছেলেটাকে বলছে–গাছভাইয়া আমার বই-এর মলাট লাগিয়ে দাও।
তিনি সুপ্তিকে ডেকে বললেন, গাছ ভাইয়া ডাকছিস কেন? গাছ ভাইয়াটা কী?
উনি নিজেকে গাছ বলেন তো তাই গাছ ভাইয়া বলে ক্ষেপাই।
বাবুল নিজেকে গাছ বলে?
হুঁ। বলে আমি মানুষ না, আমি গাছ।
সে গাছ হবে কেন?
আহ বাবা তুমিও দেখি কিছু বোঝ না। ঠাট্টা করে বলে। মানুষ কি কখনো গাছ হয়?
ঠাট্টা করে বলে?
অবশ্যই ঠাট্টা করে বলে। তোমার কী ধারণা—উনি সত্যি গাছ?
মবিন উদ্দিনের কোনো ধারণা নেই। তাঁর মাখা এলোমেলো হয়ে আছে। বাবলু যদি তাকে বলে—আমি কাঁঠাল গাছ। তিনি হয়তোবা বিশ্বাস করবেন। তার গা থেকে কাঁঠাল বের হলেও তেমন অবাক হবেন না। পেরে ঘরের কোণায় রেখে দেবেন পাকাবার জন্যে।
দুপুর একটার মতো বাজে। মবিন উদ্দিন খবরের কাগজ ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালেন। ক্ষিধে পেয়েছে বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করবেন। কিছুক্ষণ ঘুমাবেন। ঐ দিন সুরমা বলছিল—আচ্ছা এখন তুমি আর দুপুরের পর দোকানে যাও না কেন?
বিক্রিবাটা নেই। কাজেই যাই না। রেস্ট নেই। তাছাড়া শরীরটাও ভাল
বাবলুকে পাঠিয়ে দাও, ও দোকানে বসুক। দিনের পর দিন দোকান বন্ধ রাখলে লোকজন ভাববে তুমি দোকান বিক্রি করে দিয়েছ।
মবিন উদ্দিন রাগী গলায় বললেন, দোকান বিক্রি করব কেন? কী সব আজগুবি কথা বল।
হঠাৎ এমন রেগে গেলে কেন? রাগার মতো কিছুতো বলিনি। তোমার শরীরতো আসলেই খারাপ করেছে। আজকাল খুব অল্পতেই রেগে যাচ্ছ। তোমার বিশ্রাম দরকার।
বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টাইতো করছি—তুমি এসে বকবক করে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলে।
আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। তুমি ঘুমাও।
সুরমা চলে যায় ঠিকই, কিন্তু যাবার আগে কিছুক্ষণ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে। সে কি কিছু আঁচ করছে? আঁচ করা বিচিত্র না। এত বড় ঘটনা বেশিদিন গোপন করে রাখা যাবে না। প্রকাশ হয়ে পড়বেই। তাঁরই উচিত সুরমাকে জানানো। কীভাবে জানাবেন মাথায় আসছে না।
মোহনগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ আপ ট্রেন আসছে। স্টেশনে তুমুল ব্যস্ততা। চার-পাঁচ কামরার ছোট্ট ট্রেন, প্ল্যাটফরমে চার-পাঁচশ যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেনে তিল ধারণের জায়গা থাকবে না, অথচ স্টেশনের সব যাত্রী ট্রেনে উঠে যাবে। কীভাবে উঠবে সেটাও এক রহস্য। আসলে পৃথিবীটাই রহস্যময়। কালো যাদুকরের রহসই একমাত্র রহস্য না। মবিন উদ্দিন বাড়ির দিকে রওনা হলেন।
দরজা খুলে দিলেন সুরমা।
সুরমার মুথ অসম্ভব গম্ভীর। চোখ ফোলা ফোলা। অনেকক্ষণ কাঁদলেই চোখ এমনভাবে ফুলে উঠে। মবিন উদ্দিন শংকিত গলায় বললেন, তোমার কী হয়েছে?
সুরমা ধরা গলায় বললেন, কিছু হয়নি। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
মবিন উদ্দিন নিচু গলায় বললেন, কী কথা?
খাওয়া-দাওয়া কর তারপর বলব।
এখনি বল শুনি।
তুমি নাকি রোজ স্টেশনে বসে থাক?
কে বলেছে?
কে বলেছে সেটা পরের কথা। বসে থাক কি-না সেটা বল।
হ্যাঁ বসে থাকি।
স্টেশনে বসে কী কর?
খবরের কাগজ পড়ি।
খবরের কাগজ পড়ার জন্যে স্টেশনে যেতে হয়। আগেতো দোকানে বসেই কাগজ পড়তে। এখন দোকানে বস না কেন?
মবিন উদ্দিন চুপ করে রইলেন। চুপ করে থাকা ছাড়া তার পথও নেই। কী বলবেন? সুরমা এমনভাবে তাকাচ্ছে যে তাঁর তৈরী মিথ্যা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। মাথা কঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে।
তুমি না-কি দোকান বিক্রি করে দিয়েছ?
হুঁ।
কেন?
আব্দুল মজিদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছিলাম। তার মেয়ের বিয়ে, টাকাটা তাকে দেয়া দরকার।
টাকা কবে ধার করেছিলে?
অনেকদিন আগেই নিয়েছিলাম। তোমাকে বলা হয়নি।
আমাকে তো তুমি কিছুই জানাও না। কেন জানাও না? এই ব্যাপারটা জানাতে কি কোনো সমস্যা ছিল?