.
মবিন উদ্দিন বাড়ি ফিরলেন সন্ধ্যার আগে আগে। তার মুখে লজ্জিত ভাব। হাতে কাপড়ের প্যাকেট।
সুরমা বললেন, প্যাকেটে কী?
মবিন উদ্দিন ইতস্ততঃ করে বলরেন, সুপ্তির জন্যে একটা শাড়ি এনেছি। মেয়েটা অনেকদিন থেকে শাড়ি শাড়ি করছিল।
ভাল করেছ।
তোমার জন্যেও একটা শাড়ি কিনেছি। দেখতো রংটা পছন্দ হয় কি-না। ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার জন্যে একটা পাঞ্জাবি এনেছি। ওকে দিয়ে আস।
সুরমা বিস্মিত হয়ে বলল, সবার জন্যে কাপড় জামা ব্যাপার কী?
কোন ব্যাপার না। কিনলাম।
টাকা পেয়েছ কোথায়?
ছিল কিছু। শাড়িটা পছন্দ হয়েছে?
সুরমা আনন্দিত গলায় বললেন, খুব পছন্দ হয়েছে।
অজুর পানি দাও। মাগরেবের নামাজ পড়ব।
সুরমা অজুর পানি দিতে দিতে বললেন, তুমি যে কবিরাজী অষুধটা দাও আমার মনে হয় অষুধটা কাজ করছে। সুপ্তির ব্যথা উঠেছিল অল্প কিছুক্ষণ ছিল। বেশি হলে বড়জোর এক মিনিট। তারপর চলে গেল।
বল কী এটাতো খুবই আনন্দের খবর।
আনন্দের খবরতো বটেই। আমি দশ রাকাত শোকরানা নামাজ পড়েছি।
সুপ্তি কোথায়?
বাবলুর সঙ্গে গল্প করছে। ডাকব?
না থাক ডাকার দরকার নেই। শাড়িটা ওকে দাও—পরুক। দেখি মেয়েকে কেমন লাগে। ভাল কথা—আব্দুল মজিদ কি এসেছিল?
না তে। উনার আসার কথা না-কি?
হুঁ। আসলে বসিয়ে গল্প-টল্প কর। আমার নামাজ শেষ হতে দেরি হবে। সারাদিনের নামাজ কাজা হয়েছে।
মবিন উদ্দিন অনেকক্ষণ ধরে নামাজ পড়লেন। নামাজে বসেই সুপ্তির আনন্দের চিৎকার শুনে বুঝলেন, তার শাড়ি খুব পছন্দ হয়েছে।
তাঁর নামাজ বোধহয় হচ্ছে না। মন বাইরে চলে যাচ্ছে। আব্দুল মজিদ এসেছে এটাও নামাজে বসে টের পেলেন। তার সঙ্গে সুপ্তির যে কথাবার্তা হচ্ছে তাও শুনতে পাচ্ছেন।
ফুপা কেমন আছেন?
খুব ভাল আছি মা।
ফুপা দেখেন বাবা আমার জন্যে একটা শাড়ি কিনে এনেছেন। কী সুন্দর রঙ দেখেছেন? বাবা কখনো ভাল কিছু কিনতে পারে না। এই প্রথম ভাল জিনিস কিন।
রঙটা তো সুন্দর।
মা’র শাড়িটা দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। মা’র শাড়িটা আরো অনেক সুন্দর। মজার ব্যাপার কি জানেন ফুপা? মা’র বেশি পছন্দ আমার শাড়িটা, আবার আমার পছন্দ মা’র শাড়িটা।
দু’জনে বদলাবদলি করে নাও।
উহুঁ তা করব না।
ভাইজান কি ঘরে আছেন?
হুঁ আছেন। এই একটু আগে ফিরেছেন। নামাজ পড়ছেন। ফুপা আপনি বসুন। চা দেই।
কষ্ট না হলে দীও। ভাল কথা তোমাদের সঙ্গে একটা ছেলে নাকি থাকে? ম্যাজিক দেখায়?
হুঁ থাকে। তার সঙ্গে কথা বলবেন? ডাকব?
না এখন থাক। পরে কথা বলব। তুমি দেখ ভাইজানের নামাজ শেষ হয়েছে কি-না।
মবিন উদ্দিন নামাজ শেষ করে বসার ঘরে গেলেন। আব্দুল মজিদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। এবং যথারীতি কদমবুসি করল। বিনয়ের সঙ্গে আব্দুল মজিদ বলল, ভাইজান ভাল আছেন?
মবিন উদ্দিন বললেন, ভাল আছি। তুমি বোস। তার মাথার ভেতর একটা ধাক্কার মত অনুভব করলেন। তাঁর সমস্ত মাথা ঘুরে উঠল। কানের ডগা ব্যথা করতে লাগল। এবং তিনি অসম্ভব বিস্ময়ের সঙ্গে আব্দুল মজিদের দিকে তাকালেন। কারণ তার মনে হল তিনি আব্দুল মজিদ মনে মনে কী ভাবছে সব বুঝতে পারছেন। এটা কি তার মনের কল্পনা, না তিনি সৃতি বুঝতে পারছেন। মানুষের মনের কথা বুঝতে পারার কোন কারণ নেই। অথচ তিনি যে মনের কথা বুঝতে পারছেন তা সত্যি। এখানে কোন ভুল নেই।
আব্দুল মজিদ মনে মনে ভাবছে–ছাগলা ব্যাটা কি টাকা জোগাড় করেছে। মনে তো হয় না। এদিকে শাড়ি ফাড়ি কিনে হুলুস্থুল। নামাজও পড়ল লম্বা চওড়া। নামাজে কাজ দিবে না। আমাকে চেনে না। অনেক দিন সবুর করেছি এইবার ধরলাম। ধরছি যখন ছাড়ব না।
মবিন উদ্দিনের খুবই অস্বস্তি লাগছে। একী কান্ড। আব্দুল মজিদু এইসব কী ভাবছে। সুপ্তি এসে চা দিয়ে গেল। আব্দুল মজিদ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, মা চা ভাল বানিয়েছ। অনেক দিন পর ভাল চা খেলাম। তোমার ফুপু রান্না বান্নায় ভাল। চা বানাতে দাও—আর পারবে না। তুমি একদিন গিয়ে তোমার ফুপুকে চা বানানো শিখিয়ে দিও গো মা।
মবিন উদ্দিন বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন, আব্দুল মজিদ মনে মনে অন্য কথা বলছে। সে বলছে—এটা কী বানিয়েছে? ধামড়ি মেয়ে চা বানানো শিখেনি। কয়েকটা পাতা দিয়ে পানি গরম করলেই চা হয়ে গেল। এই চা খাওয়া আর চিনি দিয়ে ঘোড়ার পিসাব খাওয়া এক জিনিস।
আব্দুল মজিদ হাসিমুখে তাকাচ্ছে। মবিন উদ্দিন সেই হাসি দেখে শিউরে উঠলেন। মানুষের ভেতরের এবং বাইরের রূপের এত তফাৎ মানুষ এত অদ্ভুত!
ভাইজান টাকাটার কি জোগাড় হয়েছে?
মবিন উদ্দিন বললেন, হ্যাঁ হয়েছে।
আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন ভাইজান। খুব টেনশানে ছিলাম। কী যে ভাল লাগছে। মনে হল ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
মবিন উদ্দিন বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন, আব্দুল মজিদের মনের কথা সম্পূর্ণ অন্য। আব্দুল মজিদ বলছে—গাধাটা বলে কী টাকা জোগাড় করে ফেলেছে। পেয়েছে কোথায়? জমিজামা বিক্রি করেছে? না-কি দোকান বেচে দিয়েছে। দোকান বিক্রি করলে সবার মনটন খারাপ থাকতো। শাড়ি ফাড়ি কিনে আমোদ-ফুর্তি করত না। জমা টাকা? গাধাটার এত টাকা ছিল? ইস আগেই টাকাটা নেয়া উচিত ছিল।
ভাইজানের টাকার জোগাড় করতে কষ্ট হয় নি তো?
না কষ্ট হয় নাই।
মবিন উদ্দিন বুঝতে পারছেন আব্দুল মজিদ মনে মনে বলছে–আচ্ছা ব্যাটা কি টাকাটা সত্যি জোগাড় করেছে? না-কি এখনি বলবে, মজিদ টাকাটা একজনের দিয়ে যাবার কথা। এখনো আসছে না কেন বুঝতে পারছি না। যাই হোক তুমি চলে যাও। আমি কাল পরশু নিয়ে আসব। এইসব বলে লাভ হবে না। আমি যাচ্ছি না।