সুপ্তি স্কুল গেটের কাছে এসে দাঁড়াল। তার একটু ভয় ভয় লাগছে যদিও সে জানে ভয়ের কিছুই নেই। ভয় পেলেই ভয়। জিয়োগ্রাফী আপা প্রায়ই বলেন-”বনের বাঘে খায় না। মনের বাঘে খায়।” আসল বাঘের চেয়ে মনের ভেতরে যে বাঘ বাস করে সেই বাঘ অনেক অনেক অনেক ভয়ংকর।
সুপ্তি কোন রকম সমস্যা ছাড়া বড় রাস্তায় এল। রাস্তা পার হল। চায়ের দোকান পার হয়ে গলিতে ঢুকে পড়ল এইসময় একটা সমস্যা—হুড়মুড় করে সাইকেল নিয়ে কে একজন তার গায়ে উঠে পড়ল। সুপ্তির হাত থেকে বইখাতা ছিটকে পড়ে গেল। সাইকেলওয়ালাও তার সঙ্গে পড়ে গিয়েছে এবং সে মনে হয় ভালই ব্যথা হয়েছে। সুপ্তি উঠে পড়েছে নিজে নিজে, কিন্তু সাইকেলওয়ালাকে লোকজন ধরে তুলল। সে রাগী গলায় বলল, দেখেশুনে চলতে পার না। তুমি কি আন্ধা। দেখতেছে সাইকেল নিয়ে আসতেছি। তারপরও সরে না।
সুপ্তি বলল, আপনি হর্ণ দেননি কেন?
হর্ণ দেব কেন? তুমি চোখে দেখ না? চোখ নাই?
সুপ্তি প্রায় বলেই ফেলেছিল তার চোখ আছে কিন্তু সে দেখতে পায়নি। সুপ্তি বলল না। কারণ হঠাৎ তার মনে প্রচণ্ড একটা ভয় ঢুকে গেছে। সে দিক ঠিক করতে পারছে না। সে কোন দিকে যাবে। সোজা যাবে, না পেছন দিকে যাবে? তার এরকম হল কেন? আশেপাশে কোথাও একটা সাইকেল পার্টস এর দোকান থাকার কথা। সেটা কোন দিকে?
হাতের ছিটকে পড়া বইগুলি তোলা দরকার। বইগুলি কোথায় পড়েছে? জ্যামিতি বক্সের আশেপাশে? জ্যামিতি বাক্স কোথায় পড়েছে সে জানে। পড়ার শব্দ শুনেছে। বইগুলিও শব্দ করেই পড়েছে। তবে অনেকগুলি বই। বই পড়ে যাবার শব্দ একরকম। জ্যামিতি বাক্সের শব্দ আলাদা। সুপ্তি নিচু হয়ে জ্যামিতি বাক্স তুলল। বই তোলার জন্যে এদিক ওদিক হাত দিচ্ছে ওমি একজন বলল, এই মেয়ে আন্ধা। সুপ্তির শরীর শক্ত হয়ে গেল। বই না তুলেই সে উঠে দাঁড়াল। সুপ্তি লক্ষ্য করল অনেকদিন পর তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে এতগুলি লোকের সামনে কেঁদে ফেললে সমস্যা হবে। মনে হচ্ছে সত্যি চোখে পানি এসে যাবে। যে করেই হোক চোখের পানি আটকাতে হবে।
ও আল্লা সত্যি চক্ষে দেখে না। এই তুমি একলা কই রওনা হইছ। তোমার বাড়ি কোনখানে?
সুপ্তি বাসায় ফিরল রিকশা করে। যে ছেলে সাইকেলে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিয়েছে সে সাইকেলে করে তার পেছনে পেছনে এসেছে। খুবই বিরক্তিকর ছেলে। পেছনে থেকে সারাক্ষণ কথা বলছে—
কী নাম তোমার?
সুপ্তি।
তুমি আমার খুব রাগ করেছ তাই না?
না।
আমি জানি রাগ করেছ। আমি আসলেই বুঝতে পারিনি।
আমি রাগ করিনি।
তুমি কি সব সময় এ রকম একা একা চলাফেরা কর। এটাতো ঠিক না।
আপনি আমার পেছনে পেছনে আসছেন কেন? আপনি চলে যান।
তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
পৌঁছতে হবে না।
পৌঁছাতে হবে কি হবে না, সেটা আমি বুঝব। সুপ্তি শোন আমার নাম জহির। আমি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।
ও আচ্ছা।
নেত্রকোনায় আমার দাদার বাড়ি। দাদা অসুস্থ উনাকে দেখতে এসেছিলাম।
ও আচ্ছা।
তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছ?
আমি তো আপনাকে বললাম রাগ করিনি। আমাদের বাড়ি চলে এসেছে। সামনের টিনের বাড়িটা আমাদের আপনি এখন যান।
তুমিতো চোখে দেখতে পাও না। তুমি বুঝলে কী করে সামনের বাড়িটা তোমাদের?
আমি অনুমানে অনেক কিছু বুঝতে পারি।
তুমি কি সত্যি সত্যি চোখে দেখ না?
না।
আমার নামটা তোমার কি মনে আছে–জহির।
আপনার নাম মনে রেখে কী হবে?
বলেই সুপ্তি ঘরে রিকসা থেকে নামল। রিকসা ভাড়া দেবার সময় পেল না, জহির দিয়ে দিল। সুপ্তি বলল, আপনি এখন চলে যান। অনেকক্ষণ বিরক্ত করেছেন। আর করবেন না। সুপ্তি ঘরে ঢোকার পরেও জহির কিছু সময় লজ্জিত মুখে বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।
দুপুরে ম্যাজিশিয়ান ভাত খাচ্ছে আর সুপ্তি খুব আগ্রহ করে বলছে আজ সে কী করে একা একা হেঁটে চলে এসেছে। পথে সামান্য সমস্যা হয়েছিল তবে সেই সমস্যা সামাল দেয়া গেছে। ম্যাজিশিয়ান বলল, একা একা আসতে পেরে তুমি খুব খুশি?
সুপ্তি বলল, হ্যাঁ খুশি। আমি অন্যসব মানুষের মতো চলাফেরা করতে চাই। কেউ যেন কোনদিন বুঝতে না পারে যে আমার কোন সমস্যা আছে।
ম্যাজিশিয়ান বলল, তা তুমি করতে পারবে।
কী করে বললেন?
আমি অনেক কিছু বলতে পারি।
সুপ্তি হাসতে হাসতে বলল, আপনি অনেক কিছু বলতে পারেন কী জন্যে? আপনি মানুষ না আপনি গাছ এই জন্যে?
তোমার বিশ্বাস হয় না, তাই না?
না হয় না, কারণ আমি তো আর গাছ না, আমি মানুষ। মানুষদের অনেক বুদ্ধি। তারা চট করে কিছু বিশ্বাস করে না। তার একটা কথা বলি? আপনি আমাদের মতোই সাধারণ একজন মানুষ। একটাই তফাৎ, আপনি সুন্দর ম্যাজিক জানেন। আমরা জানি না। ম্যাজিক জানলেই মানুষ অন্য রকম হয়ে যায় না।
সুপ্তি শোন, আমি কিন্তু আসলেই মানুষ না।
সুপ্তি বলল, মানুষ না হলে আপনি কে?
আমি তো আগেও তোমাকে বলেছি। আমি আসলে গাছ।
সুপ্তি গম্ভীর মুখে বলল, বেশি বেশি গাছ গাছ করবেন না-তে। বেশি বেশি গাছ গাছ করলে আমরা আপনাকে কেটে লাকড়ি বানিয়ে সেই লাকড়ি দিয়ে হয়তো বেঁধে খেয়ে ফেলব।
বলতে বলতে সুপ্তি হেসে গড়িয়ে পড়ল। ম্যাজিশিয়ান ছেলেটা তাকিয়ে। আছে। অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। চোখের পাতা পড়ছে না। তার বড় বড় চোখ চক চক ঝক ঝক করছে। সেই চোখের দিকে তাকালে বুকের ভেতর হঠাৎ ধ্বক করে একটা ধাক্কা লাগে।