এবার কলামটার দিকে তাকিয়ে থাক। দৃষ্টি পুরোপুরি কলমটার উপার। অন্য কোন দিকে তাকাবে না। আড় চোখেও না।
আমার তাকানো না তাকানোয় তো কিছু যাচ্ছে আসছে না। আমি তো কিছু দেখছি না।
তবু তাকিয়ে থাক।
সুপ্তি তাকিয়ে থাকল।
চোখের পাতা ফেলবে না।
পাতা ফেললে কী হবে?
ম্যাজিক হবে না।
সুপ্তি তাকিয়ে থাকে তা ফেলার জন্য চোখে পানি জমতে শুরু করে এবং তখন মনে হয় হাতের ভেতরই কলমটা যেন বদলে যাচ্ছে। কোন অদ্ভুত উপায়ে যেন জীবন্ত হয়ে যাচ্ছে। জিনিসটা যেন হাতের ভেতর ছটফট করছে। ভয় পেয়ে কলমটা ফেলে দিয়ে সুপ্তি বিস্মিত হয়ে বলে,এটা আপনি কীভাবে করেন?
সে হাসে।
সুপ্তি বলে, না হাসলে হবে না। কিছু জিজ্ঞেস করলেই আপনি শুধু হাসেন। হাসি বন্ধ। আপনাকে বলতে হবে।
এই ধরনের ম্যাজিক খুবই সহজ। ইচ্ছা করলে তুমিও পারবে।
তাহলে আমাকে শিখিয়ে দিন। আমি স্কুলে বন্ধুদের দেখাব। ওদের আক্কেল গুড়ুম করে দেব।
সে গম্ভীর হয়ে বলে, আচ্ছা শেখাব।
কবে শেখাবেন বলুন। তাড়াতাড়ি শেখাতে হবে। নয়তো একদিন দেখবেন ম্যাজিক শেখার আগেই আমি ফট করে মরে গেছি।
মরে যাবে কেন?
ও আচ্ছা আপনাকে বলা হয়নি–আমি বেশিদিন বাঁচব না।
সেটা কী করে জান?
খুব ভাল করে জানি। কোন একদিন আমি ফট করে মরে যাব। কীভাবে মরবো তাও জানি।
কীভাবে মরবে?
পুকুরে ডুবে। আমাদের নানার বাড়িতে বিরাট একটা পুকুর আছে। পুকুরটার চারদিকে নারকেল গাছ। খুব গভীর পুকুর। কোন একদিন নানার বাড়িতে যাব। সারাদিন মনের আনন্দে পুকুরের চারদিকে হাঁটব। তারপর…
তারপর কী? তারপর ঝপাং।
ঝপাং মানে?
আমি লাফ দিয়ে পুকুরে পড়ে যাব। আর উঠব না। কারণ আমি সাঁতার জানি না।
এইটা তুমি ঠিক করে রেখেছ?
হুঁ। অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। শুধু একজনকে বলেছিলাম, ভাইয়াকে। আর এখন বললাম আপনাকে, আপনি বোধহয় আমার কথা বিশ্বাস করেননি। তাই না?
ম্যাজিশিয়ান কিছু বলল না। সুপ্তি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ভাইয়াও বিশ্বাস করেনি। ভাইয়ার সঙ্গে আসলেই আপনার অনেক মিল। বিশ্বাস না করলে নাই। এইসব আলাপ করতে ভাল লাগছে না। অন্য কোনো আলাপ করুন। আচ্ছা বলুন তো পৃথিবীর সবচে বড় ম্যাজিশিয়ান কে ছিলেন? আপনার কি ধারণা পিসি সরকার? হয়নি। মারলীন। ইংল্যান্ডের রাজা কিং আর্থারের সভাতে উনি ছিলেন একজন সভাসদ। তার মতো বড় ম্যাজিশিয়ান এই পৃথিবীতে হয় নি কোনোদিন হবেও না।
তোমাকে কে বলেছে?
আমাদের জিয়োগ্রাফি ম্যাডাম। উনি যেমন রাগী তেমনই জ্ঞানী।
আমার ধারণা এই পৃথিবীর সবচে বড় ম্যাজিশিয়ান হল গাছ।
গাছ?
হ্যাঁ গাছের মতো ম্যাজিক আর কেউ জানে না। এদের ম্যাজিক তুলনাহীন।
বাবা যে বলে আপনার মাথা খারাপ, ঠিকই বলে। আপনার মাথা পুরোপুরি মাসকান্দা।
মাসকান্দা মানে কী খুব বেশি মাথা খারাপ?
হুঁ। মাসকান্দা মানে হল চিকিৎসার অতীত মাথা খারাপ। দিনকান্দা মানে–চিকিৎসা করলে সারবে। মাথা খারাপ হোক আর যাই হোক আপনাকে আমি কিন্তু খুব পছন্দ করি। এটা কি আপনি জানেন?
জানি।
কতটা পছন্দ করি তা-কি আপনি জানেন?
হ্যাঁ তাও জানি।
আপনি নিশ্চয়ই আমাকে পছন্দ করেন। করেন না?
হ্যাঁ করি।
কতটুক পছন্দ করেন?
আমার পছন্দের ধরনটা আবার অন্য রকম, আমি সব মানুষকেই একই রকম পছন্দ করি।
তার মানে কি আমাকে যতটা পছন্দ করেন রাস্তার একটা ফকিরণীকেও ততটা পছন্দ করেন?
হ্যাঁ।
আপনি এ-রকম কেন?
আমি এরকম কারণ আমি ঠিক মানুষ না।
মানুষ না তাহলে আপনি কী?
আমি আসলে গাছ। এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা আসলে মানুষ না গাছ। তাদের জীবন-যাপন প্রণালী মানুষের মতো তবে…
তবে কী?
থাক তুমি বুঝবে না।
আমি ঠিকই বুঝেছি আপনি একজন ফোর্টি নাইন প্লাস ফোর্টি নাইন। ডাবল ফোর্টি নাইন।
সুপ্তি খিলখিল করে হাসছে। ম্যাজিশিয়ান ছেলেটিও হাসছে। সুপ্তি হাসি থামিয়ে বলল,
আপনি ভাইয়ার মতই ডাবল ফোর্টি নাইন।
সেও কি বলত সে গাছ?
না তা বলত না। তবে সারাক্ষণ হাসলে লোকে পাগল বলবে না? একবার কি হয়েছে শুনুন, বাবা রাগ করে ঠাশ করে তার গালে চড় মেরেছে। সে চড় খেয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। কেন বলুন তো?
বলতে পারছি না।
কারণ—চড়ের শব্দ হল–ঠাশ। কিন্তু বাবার চড়ের শব্দটা না-কি ছিল ধরাম। দরজা বন্ধ করার মতো শব্দ। এই জন্যে হাসছিল।
তোমার ভাইয়া তো খুব মজার মানুষ ছিলেন।
মোটেই মজার মানুষ ছিল না। ভাইয়া ছিল—ডাবল ফোর্টি নাইন। মাসকান্দা টাইপ।
ম্যাজিশিয়ান সুপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। সুপ্তি মাথা ঝাকিয়ে বলল, আচ্ছা বাদ দিনতো এই নিয়ে কথা বলতে আমার ভাল লাগছে না। অন্যকিছু নিয়ে কথা বলুন। আচ্ছা আমি একটা ছড়া বলছি মন দিয়ে ছড়াটা শুনুন—
গুণধর ছেলে সে মায়ের আদর
খেলতো না, হাসতো না, নামটি সাগর
তনুতার কৃশকায় মুখটি করুণ।
ছেলেটি কী খেত—আপনি বলুন।
কী বলতে পারবেন, সাগর নামের ছেলেটা কী খেত?
না বলতে পারছি না।
ছড়ার প্রতিটি লাইনের প্রথম অক্ষরটা আলাদা করুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন সাগরের প্রিয় খাদ্য কী? হি হি হি।
সুপ্তি হাসছে। ম্যাজিশিয়ান তার দিকে তাকিয়ে আছে।
.
আজ বুধবার। মবিন উদ্দিন তার দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন। দুই লাখ দশ হাজার টাকা পেয়েছেন। তাড়াহুড়া করে বিক্রি করতে হল। খোঁজ-খবর করে বিক্রি করতে পারলে হয়ত আরো বেশি পেতেন। পুরো ব্যাপারটা করতে হয়েছে। গোপনে। সুরমা সুপ্তি কেউ জানে না। ইচ্ছা করেই জানাননি। তারা খুব মন খারাপ করতে। বিক্রি না করে উপায়ও ছিল না। বুধবার সন্ধ্যায় আব্দুল মজিদ চলে আসবে। ভদ্র এবং বিনয়ী গলায় বলবে, ভাইজান টাকাটা। আপনাকেতো বলেছিলাম খুব দরকার।