হ্যাঁ করি তাতে অসুবিধা কী! একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে পছন্দ করতে পারে না?
আগে যে বলতে ছেলেটা মানুষ না। জ্বীন এখন আর তা বল না।
কী ধরনের কথা তোমার, শুধু শুধু একটা ছেলেকে আমি জীন বলব কেন? আমার কি মাথাটা খারাপ হয়েছে।
না, তোমার মাথা ঠিকই আছে।
সুরমা বললেন, আমার সঙ্গে এসো একটা জিনিস দেখে যাও।
কী দেখব?
সুপ্তি ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার ঘর কী সুন্দর করে সাজিয়েছে দেখে যাও। আমি ঘরে ঢুকে অবাকই হয়েছি। মন লাগিয়ে কাজ করলে সুপ্তি ঘরের কাজ ভাল করে। এসে দেখে যাও।
এখন না। পরে দেখব।
সুপ্তির হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার মনে খুব আনন্দ। এত আনন্দ ভাল না। যত আনন্দ তত দুঃখ। এই জন্যেই যাদের জীবনে আনন্দের ভাগ কম তাদের জীবনে দুঃখও কম। এটাও বোধহয় ঠিক না, তার জীবনে আনন্দ, নেই বললেই হয় অথচ দুঃখতো তাই বলে কম তাতো না। বুধবারের মধ্যে এক লক্ষ টাকা জোগাড় করতে হবে। কোথায় পাবেন এত টাকা?
সুপ্তি হাসছে। মর্কিন উদ্দিন মেয়ের হাসি শুনছেন। ম্যাজিশিয়ান ছেলেটাকে বিদায় করে দিলে তার এই মেয়েটা সবচে’ কষ্ট পাবে। তার এই মেয়েটা দুঃখী। তার দুঃখের কোন সীমা নেই। অন্য কেউ তা জানুক বা না জানুক, তিনি জানেন। তার এই মেয়েটা যখন গভীর আনন্দ নিয়ে ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে তখন তার ভাল লাগে। আহা মেয়েটা আনন্দে থাকুক। আনন্দ মেয়েটার জন্যে খুব দরকার।
.
সুপ্তির সঙ্গে টুনুর ভাবটা সবচে বেশি। সে বিকট একটা চিৎকার দেবে, “ম্যাজিক ভাইয়া, ও ম্যাজিক ভাইয়া।”
ম্যাজিক ভাইয়া ঘর থেকে হাসি মুখে বের হবে। সুপ্তি তাকে দেখে হড়বড় করে বলবে, আজ স্কুলে কী হয়েছে শুনে যান। শুনলে আপনার দম বন্ধ হয়ে যাবে। দারুণ একটা ঘটনা ঘটেছে। জিয়োগ্রাফি মিসের কথা আপনাকে বলেছি না খুব রাগী। আমাদের হেড মিসট্রেস আপা পর্যন্ত তাঁকে ভয় পান। এই মিস আজকে চেয়ার ভেঙ্গে হুড়মুড় করে পড়ে গেছেন। আমাদের হাসি আসছে কিন্তু আমরা হাসতে পারছি না। ভয়ে কাঠ হয়ে আছি। তখন কী হল জানেন? কেউ হাসল না। আমাদের ফার্স্ট গার্ল সাদেকা হঠাৎ খিল খিল করে হেসে ফেলল, সেই হাসি আর থামেই না। জিয়োগ্রাফি আপা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তিনি চিন্তাও করতে পারেননি সাদেকা হাসতে পারে। এই হল সুপ্তির রোজকার রুটিন। প্রতিদিনই তাদের স্কুলে মজার মজার কিছু ঘটছে। স্কুল থেকে ফিরেই সেই সব মজার ঘটনা ম্যাজিক ভাইয়াকে না শোনানো পর্যন্ত সুপ্তির শান্তি নেই।
আগে সুপ্তিকে পড়াতেন মবিন উদ্দিন। সুপ্তি গালে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে থাকতো–মবিন উদ্দিন তার বইগুলি পড়তেন। একবার দুবার তিনবার। সুপ্তি তৃতীয়বারের সময় বলতো, বাবা আর লাগবে না হয়েছে। এখন তুমি আমার হাতের লেখা দেখ। হাতের লেখাগুলি কি এখনো বড় বড়? এরচে ছোটতো। করতে পারি না। এরচে ছোট করলে কেউ পড়তে পারবে না।
এখন সুপ্তির পড়ার ধরন বদলেছে। মবিন উদ্দিনের স্থান নিয়েছে ম্যাজিশিয়ান। সে পড়ে, সুপ্তি গালে হাত দিয়ে শোনে। এবং পড়ার মাঝখানে বলে, থুক্কু। আবার পড়েন। আমি আসলে আপনার পড়া শুনছিলাম না। অন্য কিছু ভাবছিলাম।
কী ভাবছিলে?
তা বলা যাবে না।
বলা যাবে না কেন?
বলা যাবে না কারণ আমি যদি বলি তাহলে আপনার একটু মন খারাপ হবে। আমি আপনার মন খারাপ করতে চাই না। শুধু আপনার কেন কারোরই মন খারাপ করতে চাই না।
তুমি বল–আমার মন খারাপ হবে না।
ম্যাজিক ভাইয়া, আমি যদিও খুব হাসি-খুশি থাকি তারপরেও আমার কিন্তু সারাক্ষণ মন খারাপ থাকে। ভয়ংকর মন খারাপ থাকে। প্রতি রাতে ঘুমুবার আগে আমি কাঁদি।
ও আচ্ছা।
কেন কাঁদি জানেন? কাঁদি কারণ আমার অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা করে, বুঝতে ইচ্ছা করে কিন্তু পারি না। হাজার চেষ্টা করেও পারি না। আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে আছে–হিন্দু মেয়ে, নাম অর্চনা সবাই বলে সে না-কি পরীর মত সুন্দর। আরেকটা মেয়ে আছে নাম কামরুন নেসা সবাই আড়ালে কামরুনেসাকে ডাকে মিকি মাউস। তার চেহারা না-কি ইঁদুরের মত। আমি ওদের দুজনের মুখের উপর হাত বুলিয়েছি দু’জনকে আমার একই রকম লেগেছে।
সব মানুষতো এক রকমই।
মোটেই এক রকম না, কেউ সুন্দর কেউ অসুন্দর। সেই সুন্দর অসুন্দরটাই বুঝতে পারি না। আমার খুব কষ্ট হয়। কেউ কালো, কেউ ফর্সা। কালো ফর্সা কী? আচ্ছা থাক অনেক বক বক করলাম, এখন পড়া শুরু করুন। পড়া শুরু করার আগে বলুন–আপনাকে যে সব কথা বললাম, সে সব কথা কখনো বাবা। বা মা’কে বলবেন না।
বলব না।
এইভাবে বললে হবে না। বিদ্যা ছুঁয়ে বলুন। জ্যামিতি বইটা ছুঁয়ে বলুন।
জ্যামিতি বই ছুঁয়ে শপথ করলে কী হবে?
আপনার আর জ্যামিতি শেখা হবে না। ত্রিভুজের দুটি বাহু আর তাদের অন্তঃস্থ কোণ সমান হলে যে ত্রিভুজ দুটি মন হয় এই সাধারণ ব্যাপারটাও আপনি জানবেন না।
আচ্ছা যাও শপথ করলাম।
পড়াশোনার শেষে টুনুকে ম্যাজিক দেখাতে হয়। রোজ এক একটা দেখাতে হবেই। ম্যাজিকগুলি খুর দরবার খুব সুন্দর আবার খুবই সহজ। তারচেয়েও বড় কথা চোখে না দেখেও সুপ্তি ম্যাজিকগুলি বুঝতে পারে। ম্যাজিক দেখানোর জন্যে ম্যাজিশিয়ানের কিছুই লাগে। সে সুপ্তিকে বলবে, দেখি তোমার বল পয়েন্ট কলমটা হাতে শক্ত করে ধরে থাক। সুপ্তি ধরে থাকল।