তার দরকার নেই।
আপনি নিজে যদি তাকে বের না করেন, আমি অবশ্যই বকুলের বাবাকে পাঠাব।
মবিন উদ্দিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। রাহেলা মনে হচ্ছে এই সামান্য ব্যাপারে নিয়ে ভাল ঝামেলা করবে। বকুলের বাবা আব্দুল মজিদ মানুষটা ছোটখাট এবং অত্যন্ত মিষ্টভাষী হলেও কঠিন লোক। তিনি নিজে তাকে খুবই অপছন্দ করেন। মাঝে মাঝে তার মনে হয় রাহেলার যদি এই মানুষটার সঙ্গে বিয়ে না হত তার জীবনটা অনেক সুখের হত। বস্তা বস্তা টাকা থাকলে কিছু হয় না। টাকার প্রয়োজন অবশ্যই আছে কিন্তু বস্তা বস্তা টাকার দরকার নেই।
ভাইজান!
বল।
বকুলের বাবা তোমাকে কী যেন বলবে, যাবার আগে শুনে যেও।
আচ্ছা।
মবিন উদ্দিনের অস্বস্তি লাগছে। আব্দুল মজিদের সঙ্গে কথা বলে তিনি কখনোই স্বস্তিবোধ করেন না। যদিও আব্দুল মজিদের ভদ্রতা এবং বিনয় তুলনাহীন। সেই বিনয় এবং ভদ্রতার পেছনে কিছু একটা থাকে যা অসহনীয়।
আব্দুল মজিদ মবিন উদ্দিনকে দেখেই পা ছুঁয়ে সালাম করল। হাসি মুখে বলল, ভাইজান ভাল আছেন?
মবিন উদ্দিন শুকনো গলায় বললেন, ভাল।
আপনার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে ভাইজান। স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়া দরকার। জোয়ান বয়সে স্বাস্থ্য ভাঙ্গলে সামাল দেয়া যায় শেষ বয়সে স্বাস্থ্য ভাঙ্গলে আর সামাল দেয়া যায় না।
তা ঠিক। তুমি নাকি কী বলবে আমাকে?
আব্দুল মজিদ বিনয়ে প্রায় ছোট হয়ে গিয়ে বলল, মেয়ের বিয়েতো ভাইজান একটু অসুবিধার মধ্যে পড়ে গেছি। তিন চারটা বিল আটকা। আপনার টাকাটা যদি পেতাম খুবই ভাল হত।
মবিন উদ্দিন মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। বছর চারেক আগে দোকান কেনার সময় তিনি আব্দুল মজিদের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিলেন। এই ধার শোধ করতে পারেননি।
আপনাকে বলতেও লজ্জা লাগছে। কী যে অসুবিধায় পড়েছি। এতদিন ধরে কনট্রাকটারী করছি এমন অসুবিধায় পড়িনি। আগামী বুধবার নাগাদ কি টাকাটা পাওয়া যাবে ভাইজান?
মবিন উদ্দিন চুপ করে রইলেন। আব্দুল মজিদ বলল, আপাতত আপনি টাকাটা দেন পরে প্রয়োজন বোধে আবার নিবেন। আমার কোন উপায় নেই ভাইজান টাকার ব্যবস্থা আপনাকে করাই লাগবে।
মবিন উদ্দিন নিজের অজান্তেই বললেন, আচ্ছা।
আব্দুল মজিদ বলল, রাহেলার কাছে শুনেছি কী একটা ছেলে নাকি আপনার বাড়িতে ঢুকে পরেছে। দরকার মনে করলে আমাকে বলবেন—শুয়োরের বাচ্চাকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলব। ফাজলামীর জায়গা পায় না।
শুধু শুধু তাকে মেরে তক্তা বানাবে কেন? এটা কি ধরণের কথা।
ঝামেলা করলে একটু বলবেন। না মেরেও অনেক কিছু করা যায়।
তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমিই করব।
ঠিক আছে ভাইজান। অসুবিধা হলে আমাকে খবর দিবেন। আর ভাইজান বুধবারে টাকাটার জন্য আমি নিজেই আসব। সন্ধ্যার দিকে আসব। গরজটা আমার। আপনার কাছে চাইতে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। না চেয়েও উপায় নেই।
মবিন উদ্দিন খুবই মন খারাপ করে ফিরলেন। খালি হাতে ফিরলেন না, আব্দুল মজিদ পুকুর থেকে মার দু’টা সিলভার কার্প মাছ সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে।
মাগরিবের নামাজ শেষ করে
মাগরিবের নামাজ শেষ করে মবিন উদ্দিন শোবার ঘরে চুপচাপ বসে আছেন। আজো ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। ঘর অন্ধকার মেঝেতে হারিকেন জ্বলছে। সুরমা বাটিতে করে ভাজা মুড়ি নিয়ে ঢুকলেন। মবিন উদ্দিন বলেন, মুড়ি খাব না।
সুরমা বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে? তখন থেকে চুপচাপ বসে মাছ।
মবিন উদ্দিন জবাব দিলেন না। সুরমা বললেন, বোনের বাড়িতে কী হল বল। বকুলের বিয়ে নিয়ে নতুন কোন কথা হয়েছে?
না।
ওরা খুব খুশি না?
হুঁ।
এ রকম মুখ শুকনা করে বসে আচ্ছ কেন? ব্যাপারটা কী বলতো?
কোন ব্যাপার না। আমি ভাল লাগছে না।
রাহেলা কি তোমাকে কিছু বলেছে!
না সে আর কী বলবে।
মনে হচ্ছে তুমি কোন কিছু নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা করছ? কী নিয়ে দুঃশ্চিন্তা।
কোন কিছু নিয়ে দুঃশ্চিন্তা না। এম্নি শরীরটা ভাল লাগছে না। আচ্ছা সুরমা শোন—ম্যাজিশিয়ান ছেলেটাকে এখন চলে যেতে বললে কেমন হয়?
সুরমা বিস্মিত হয়ে বললেন, ওকে চলে যেতে বলবে কেন?
অনেক দিনতো হয়ে গেল। এখন সে তার ঘর বাড়িতে যাক।
তার কি ঘর বাড়ি আছে না-কি যে সে যাবে। যাবেটা কোথায়?
আগে যেখানে ছিল সেখানে যাবে। সারা জীবনতো আর আমরা একটা মানুষকে পলিবো না। তাই না।
তুমিতো খুবই আজগুবি কথা বলছ। একটা অসহায় ছেলে যাবার জায়গা নেই। সে তোমার কয়টা ভাত খাচ্ছে? তুমি কি তাকে পোলাও কোর্মা খাওয়াচ্ছো?
না তা না।
তা না তাহলে কী? ওকে নিয়ে তোমার সমস্যাটা কী?
বাইরের একটা ছেলে ঘরে পড়ে আছে। লোকজন নানান কথা বলাবলি কার।”
সেই লোকজনটা কে? তোমার বোন?
হ্যাঁ সে বলছিল।
কী বলছিল ওকে বিদেয় করে দিতে?
হুঁ।
আমার সংসারে কে থাকবে না থাকবে সেটা আমি দেখব। তার সংসার নিয়েতো আমি চিন্তা করি না। সে কেন আমার সংসার নিয়ে মাথা ঘামাবে।
আচ্ছা।
আমি টুনুর ঘরটা ওকে খুলে দিয়েছি। এখন থেকে এই ঘরেই সে থাকবে।
মবিন উদ্দিন স্ত্রীর দিকে তাকালেন। কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। টুনুর মৃত্যুর পর তার ঘর তালাবন্ধ ছিল। সুরমা বলেছিলেন, তিনি কোনদিন এই ঘরের তালা খুলবেন না। এই ঘরের তালা সারাজীবন বন্ধ থাকবে। সেই তালা খোলা হয়েছে।
মবিন উদ্দিন বললেন, ছেলেটাকে তুমি খুব পছন্দ কর?