সারা রাত মবিন উদ্দিনের ঘুম হল না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে ফজরের আজান শুনলেন। পাখ পাখালির ডাক শুনলেন। দেখলেন–সুরমা বিছানা থেকে নামছে। অজু করতে যাচ্ছে, তারও ওঠা উচিত। এম্নি নামাজ কাজা করা এক জিনিস আর আজান শুনে কাজা করা ভিন্ন জিনিস। তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারলেন না। প্রবল ঘুমে তলিয়ে গেলেন। ঘুমের মধ্যেই বিচিত্র একটা স্বপ্ন দেখলেন। যাদুকর এবং তিনি হাটছেন। বনের ভেতরের পায়েচলা পথে হাঁটছেন। ঘন বন, তবে খুব পরিচ্ছন্ন। বনের নীচে ঝোপ ঝাড় নেই। কার্পেটের মতো দুর্বা ঘাস। বনটা খানিকটা রহস্যময়, কারণ কোন শব্দ নেই। চারদিক সুনসান নীরবতা। বাতাসে গাছের পাতা নাড়ছে না। পাখি ডাকছে না, কিছু না। তারা দু’জন যে হাঁটছেন সেই হাঁটাও নিঃশব্দ হাঁটা।
মবিন উদ্দিন প্রথম প্রশ্ন করলেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
ছেলেটা বলল, আমরা কোথাও যাচ্ছি না তো। আপনি আমাকে কিছু জরুরি প্রশ্ন করবেন বলেছিলেন, সেই জন্যে নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে এসেছি। আপনার কি মনে হচ্ছে না জায়গাটা খুব নিরিবিলি?
তুমি কে?
আমি একটা গাছ?
কী বললে! গাছ?
জ্বি।
তুমি মানুষ না?
জ্বি না।
তুমি গাছ?
জ্বি আমি গাছ।
কী গাছ? আম না কাঁঠাল? নাকি সাধারণ জঙ্গলা গাছ?
আমি একটা গাছ সেটাই বড় কথা, কী গাছ সেটা বড় কথা না। কেউ যদি বলে সে মানুষ তাহলে তো সব বলা হয়ে যায়। মানুষের বেলায় কি আলাদা করে পরিচয় দেবার দরকার পড়ে? তাহলে গাছের বেলায় দরকার হবে কেন?
একটা গাছ মানুষ সেজে আমার বাড়িতে আছে এটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার না?
না খুব আশ্চর্য ব্যাপার কিন্তু না। অনেক গাছই মানুষ সেজে থাকে। কেউ তাদের ধরতে পারে না। অনেকে আবার জানেও না যে তারা মানুষ না তারা পাছ।
ও আচ্ছা।
আপনি কি আর কিছু জানতে চান?
তুমি মানুষের মনের কথা বলতে পার?
তা পারি। গাছদের অনেক ক্ষমতা।
গাছদের অনেক ক্ষমতা?
জ্বি। যাদের ক্ষমতা বেশি থাকে তারাই কখনো অন্যকে সেই ক্ষমতা দেখায়। ক্ষমতা যত অল্প হয় সেই ক্ষমতা প্রদর্শনের ইচ্ছও তত বেশি হয়।
তোমার আর কী ক্ষমতা আছে?
আপনাকে বলতে চাচ্ছি না।
বলতে চাচ্ছ না কেন?
আমি আপনার মাথা এলোমেলো করে দিতে চাচ্ছি না। এম্নিতেই আপনার মাখা যথেষ্ট এলোমেলো হয়ে আছে।
স্বপ্নের এই পর্যায়ে হঠাৎ ঝড় শুরু হল। প্রবল ঝড়। বাতাসের ঝাপটা আসছে আর প্রকাণ্ড সব গাছ নুয়ে নুয়ে পড়ছে। আকাশ যদিও দেখা যাচ্ছে না, মবিন উদ্দিন বুঝতে পারছেন আকাশ ঘন-কালো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এতক্ষণ যে বন নিঃশব্দ ছিল এখন তা শব্দময়। তারম্বরে পাখি ডাকছে। মট মট শব্দে গাছের ডাল ভাঙ্গছে। ভয়াবহ অবস্থা। ঝড়ের সঙ্গে শুরু হল বর্ষণ ঘন বর্ষণ। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। তিনি ছুটতে শুরু করেছেন। ছুটে কোথায় যাবেন? যেদিকেই যান সেদিকেই বন। তিনি একী মহা বিপদে পড়লেন? এর মধ্যে মেয়েকণ্ঠে হাসির শব্দ শোনা গেল। এই ভয়াবহ দূর্যোগে কে হাসে। কার এত আনন্দ?
মবিন উদ্দিনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি শুনলেন সুপ্তি হাসছে। হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়ছে। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। সুপ্তি ঘরে ঢুকল, এখন তার মুখে হাসি।
বাবা কী মজার একটা কাণ্ড যে হচ্ছে, ম্যাজিশিয়ান ভাইয়া উঠোনে বসে দাঁত মাজছিল। হঠাৎ কোথেকে একটা কাক এসে তার মাথায় করে দিয়েছে। হি হি হি।
সুপ্তির হাসি আর থামেই না। মকিন উদ্দিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার স্বপ্নের ঘোর এখনও কাটেনি, নিজের মেয়েটাকেও অচেনা লাগছে। এই বিচিত্র স্বপ্ন দেখার মানে কী?
.
স্বপ্ন স্বপ্নই। স্বপ্ন নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই। মানুষ তার এক জীবনে কত বিচিত্র স্বপ্নই না দেখে। ছোটবেলায় তিনি একবার স্বপ্নে দেখেছিলেন শেয়ালের মত সুঁচালো মুখের কী একটা প্রাণী খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে তার সঙ্গে কথা বলছে। কথা বলা শেষ করে সেই প্রাণীটা হাই তুলতে লাগল। তখন এই প্রাণীটার মা এসে বলল, এই তুই কিছু না খেয়েই ঘুমুতে শুরু করেছিস। কিছু খেয়ে নে। ওমি প্রাণীটা তার উরুতে কামড় দিয়ে একদলা গোশত তুলে নিল। প্রচণ্ড ব্যথায় তিনি জেগে উঠলেন। উরুতে কামরের দাগ-টগ কিছু ছিল না। কিন্তু অনেক দিন ব্যথা ছিল।
ছোটবেলার স্বপ্নটা যেমন অর্থহীন ছিল গত রাতের স্বপ্নও তেমন অর্থহীন। স্বপ্ন নিয়ে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কিছু নেই।
ছেলেটা অন্ধকারে দেখতে পারে এই খটকা অবশ্যি থেকেই যায়। তা সেটাও কোন বড় ব্যাপার না ম্যাজিকের কোন কৌশল হবে। ভাল ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিকের অনেক কৌশল জানে। সেও জানে। শুধু শুধু এত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কিছু নেই।
আজ ছুটির দিন—দোকান খুলতে হবে না। মবিন উদ্দিন বিশ্রাম করতে পারেন। শরীরটা তেমন ভাল যাচ্ছে না। শরীরের চেয়ে মন বেশি খারাপ ব্যবসাপাতি হচ্ছে না। দোকান বিক্রি করে অন্য কিছু করবেন? এই বয়সে অন্য কিছু করার কথা চিন্তা করাও কষ্টের। ছেলেটা বেঁচে থাকলে হত না। এই বয়সটা নৌকায় চড়ে চারদিকের শোভা দেখার বয়স। হাল ধরার বয়স না।
মবিন উদ্দিন নাস্তা করলেন। কিছুক্ষণ রোদে বসে রইলেন। আজ ঠাণ্ডা অন্যদিনের চেয়ে কম। তারপরেও রোদে বসে থাকতে ভাল লাগছে।
সুপ্তি বাবার পাশে এসে দাঁড়াল। মনি উদ্দিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু বলবি?