মবিন উদ্দিন পান নিলেন। তবে তার মনে বিরাট এক কিন্তু ঢুকে গেল। ব্যাপারটা কী? ছেলেটা যত বড় ম্যাজিশিয়ানই হোক পিসি সরকার তো না। পিসি সরকারও মনের কথা বলতে পারতেন না। এ বলছে কীভাবে? সাধু-সন্ন্যাসী পীর ফকিরদের এই সব ক্ষমতা থাকে। এই ছেলে সাধু-সন্নাসীও না পীর-ফকিরও না। এত শখের জর্দা দেয়া পান তার কাছে ঘাসের মতো লাগতে লাগল।
আরেক দিনের কথা তিনি বিরস মুখে দোকানে বসে আছেন।
বিক্রি-বাটা কিছুই নেই। কাস্টমার তো দূরের কথা মাছিও উড়ছে না। বিকেলের দিকে একজন কাস্টমার এসে একটা জ্যামিতি বাক্স নাড়াচাড়া করল। দাম জিজ্ঞেস করল কিনল না। মবিন উদ্দিন তার দোকানে বই ছাড়াও খাতা, পেন্সিল, জ্যামিতি বাক্স এই সব রাখেন। যাতে অফ সিজনে পুরোপুরি বসে থাকতে না হয়। কোনই লাভ নেই। যখন বই বিক্রি হয় না তখন অন্য কিছুও বিক্রি হয় না। মবিন উদ্দিনের ধারণা হল আজ বোধ হয় মঙ্গলবার। মঙ্গলবারটা তাঁর জন্যে খারাপ। আজ কী বার তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন। আশ্চর্য মনে করতে পারলেন না। একবার মনে হচ্ছে সোমবার আরেকবার মনে হচ্ছে মঙ্গলবার। ঘরে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। তারিখ জানা থাকলে বারটা বের করা যেত। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, তারিখটাও তার মনে নেই। নিজের উপর যখন খুবই রাগ লাগছে তখন বাবলু বলল, স্যার আজ বুধবার।
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, আজ কী বার তা কি আমি তোমার কাছে জানতে চেয়েছি?
ছেলেটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, জি না।
তাহলে শুধু শুধু বললে কেন আজ বুধবার? অকারণে কথা বলবে না। অকারণে কথা আমি নিজে বলি না। অন্য কেউ বললেও আমার ভাল লাগে না। এটা মনে রাখবে। অধিক কথা বলা মানে অকারণে আয়ুক্ষয়।
জ্বি আচ্ছা মনে রাখব।
ছেলেটার এই সব রহস্য তার ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা করে ডেকে বলেন, ঠিক করে বল তো তোমার ব্যাপারটা কী। ঝেড়ে কাশ। তুমি কি মনের কথা বুঝতে পার? পারলে বল হ্যাঁ, না পারলে বল, না। নো হাংকি পাংকি। আমি যেমন অধিক কথা বলা পছন্দ করি না, তেমনি হাংকি পাংকিও পছন্দ করি না।
ছেলেটা যদি স্বীকার করে সে মনের কথা বলতে পারে তাহলে তিনি তাকে দুটা কথা শুনিয়ে দেবেন। কঠিন ভাবে বলবেন, মনের কথা বলার এই বিদ্যা শিখলে কোথায়? এটা তো ভাল বিদ্যা না। এটা খারাপ বিদ্যা। যে বিদ্যায় মানুষের উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হয় সেই বিদ্যা খারাপ বিদ্যা। সেই বিদ্যার চর্চা করাও পাপ। কথাগুলি দেরি না করে বলে ফেলা দরকার। মবিন উদ্দিন রোজই একবার ভাবেন আজ বলবেন, শেষ পর্যন্ত জার বলা হয় না। তারপর এমন এক ঘটনা ঘটল যে মবিন উদ্দিন মনস্থির করলেন, ব্যাপারটা আজই ফয়সালা করবেন।
ঘটনাটা এরকম, মাঝরাত। তিনি ঘুমুচ্ছেন। প্রচণ্ড শীত পরেছে, তিনি লেপের নীচে ঢুকে আছেন। শীতের জন্যেই তার ঘুম হঠাৎ ভেঙ্গে গেল। জানালা ভাল মতো বন্ধ হয়নি হুহু করে তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর মনে হল বসার ঘরে কে যেন হাঁটাহাঁটি করছে। জিনিস পত্র নাড়াচাড়া করছে। চোর নাতো? কৃষ্ণপক্ষের শীতের রাতগুলি চোরদের জন্যে খুবই আনন্দের। গায়ে তেল মেখে মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে চুরি করতে যায়। খুট খাট শব্দ যতই হোক গৃহস্থ জাগবে না। শীতের রাতের সুখের ঘুম ঘুমাবে। ঘর কবরের মতো অন্ধকার। ট্রান্সফরমার বাস্ট করেছে বলে সাতদিন ধরে ইলেকট্রিসিটি নেই। ট্রান্সফরমার ঠিক করারও কিছু হচ্ছে না। শহরের একটা অংশ অন্ধকারে পরে আছে। অদ্ভুত দেশ। মেঝেতে যে হারিকেন জ্বালানো ছিল সেটি কী কারণে যেন নিভে গেছে। মবিন উদ্দিন দেয়াশলাইয়ের খোঁজে বালিশের নীচে হাত দিলেন। যা ভেবেছিলেন, দেয়াশলাই নেই। সুরমার দেয়াশলাই ভীতি আছে। বালিশের নীচে বা তোষকের নীচে দেয়াশলাই দেখলেই সে সরাবে। তার ধারণা প্রায়ই আপনা-আপনি বোম ফাটার মতো দেয়াশলাইয়ের বাক্স ফেটে উঠে বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়। নেহায়েত ভঁর সাবধানতার জন্যে এ বাড়িতে কিছু হচ্ছে না। মবিন উদ্দিন সাবধানে খাট থেকে নামলেন। অন্ধকারে দরজা খুলে বসার ঘরে এলেন। চোর বাড়িতে থাকলেও দরজা খোলার শব্দে এতক্ষণে পালিয়ে যাবার কথা। তারপরেও ঘরে হাঁটাহাটির শব্দ হচ্ছে। বিস্মিত মবিন উদ্দিন বললেন, কে?
ছেলেটা বলল, জ্বি আমি।
এত রাতে জেগে আছ?
জ্বি।
কী করছ?
বই পড়ছি।
বই পড়ছি মানে। অন্ধকারে বই পড়ছ কীভাবে?
ছেলেটা কোন জবাব দিল না। মবিন উদ্দিন বললেন, কী বই পড়ছ?
সুপ্তির ইতিহাস বইটা একটু দেখছিলাম।
তুমি কী অন্ধকারে দেখতে পাও?
জ্বি।
কীভাবে দেখ? ম্যাজিকের সাহায্যে?
বাবলু জবাব দিল না। মবিন উদ্দিন বললেন, আমি গায়ে কি পরেছি তুমি বলতে পারবে?
আপনি হলুদ রং এর একটা গেঞ্জি পরে আছেন।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ইতিহাস বই পড়, আমি কাল সকালে তোমার সঙ্গে কথা বলব।
জ্বি আচ্ছা।
ভাল কথা তুমি কি বলতে পারবে আমার দেয়াশলাইটা কোথায়? বলতে পারলে বল। হারিকেনটা জ্বালিয়ে রাখি। শীতের রাতে চোরের উপদ্রব হয়।
দেয়াশলাইটা আপনার বালিশের নীচেই আছে।
আচ্ছা ঠিক আছে। কাল সকালে তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
মবিন উদ্দিন বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলেন, একী যন্ত্রণা। খাল কেটে কুমীর আনেননি তো? মনে হয় এনেছেন। কুমীরের চেয়েও ভয়াবহ কিছু নিয়ে এসেছেন। অক্টোপাস নিয়ে এসেছেন। ব্যাপারটা নিয়ে তিনি সুরমার সঙ্গে আলাপ করতে চান না। জটিল ব্যাপার থেকে মেয়েদের দূরে রাখাই নিয়ম। সমস্যার শুরুতে মেয়েদের জানানো মানে সমস্যা আরও জট পাকিয়ে ফেলা। নিয়ম হচ্ছে সমস্যা শেষ হলে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে মেয়েদের জানানো।