হতেও তো পারে টুনু নামের এই ছেলেটা আসলে একটা জ্বীন। মানুষের বেশ ধরে তাদের সঙ্গে আছে। সুরমা এক রাতে ছেলেটার সম্পর্কে তাঁর এই ভীতির কথা মবিন উদ্দিনকে বলেছিলেন। মবিন উদ্দিন বিরক্ত গলায় বলেছেন, তোমার কি ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেল? সুরমা আমতা আমতা করে বললেন, কথার কথা বলছি। জগতে কত রহস্যময় ব্যাপার ঘটে। মবিন উদ্দিন বলেছেন, জগতে কোন রহস্যময় ব্যাপার ঘটে না। একটি দরিদ্র ছেলে ম্যাজিক ফ্যাজিক দেখায়। থাকার জায়গা নেই, কয়েক দিন এখানে আছে। তোমার যদি পছন্দ না হয় বলে দাও চলে যাবে। তাও তো বলছ না। রোজ রান্না করে খাওয়া। বেশ আদর করেই তো খাওয়াচ্ছ।
ছেলেটা ওর নিজের সম্পর্কে কিছুই তো বলছে না। দেশ কোথায় এইটাই এখন বলেনি।
কোনো কারণে হয়ত বলতে চায় না।
বলতে চাইবে না কেন? এটা সন্দেহজনক না? তুমি একদিন ভাল মতো জিজ্ঞেস কর না কেন?
করব। জিজ্ঞেস করব। এখন ঘুমাও তো। ঘ্যান ঘ্যান করবে না।
আমি ঘ্যান ঘ্যান করছি?
হ্যাঁ করছ। তুমি হচ্ছ এমন একজন মহিলা যার চিন্তার সঙ্গে কর্মের কোন মিল নেই। তুমি কাজ কর উত্তরে, চিন্তা কর দক্ষিণে।
তার মানে কী?
মানে বুঝতে পারব না। সব কিছুর মানে বুঝতে পারলে তো কাজই হয়েছিল। রাত হয়েছে এখন ঘুমাও।
মবিন উদ্দিন পাশ ফিরে শুলেন। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আজ দুপুরেই তিনি সুরমাকে দেখেছেন ম্যাজিশিয়ন ছেলেটির সঙ্গে অদিখ্যেতা করছে। তাকে খেতে দেয়া হয়েছে। ছেলেটা বলল, সে সজনে ডাঁটা খাবে না। সুরমা অবাক হয়ে বলল, এ কী সজনে ডাঁটা খাবে না কেন? খুবই পুষ্টির জিনিস। খাও বললাম। না খেলে আমি খুবই রাগ করব। আমার রাগ কী জিনিস তুমি জান না।
অচেনা অজানা একটা ছেলে, সে সজনে ডাঁটা না খেলে না খাবে। এত কেন সাধাসাধি?
খাবার পর টক দৈ-এর বাটি বের হল। মবিন উদ্দিন জানেন টক দৈ ছেলেটার জন্যে আনা হয়েছে। তিনি বা সুপ্তি কেউই টক দৈ খায় না। ম্যাজিশিয়ান ছেলেটা অত্যন্ত পছন্দ করে খায়। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে তার ছেলে টুনুও টক দৈ পছন্দ করে খেত। রোজ খাওয়া শেষ করে বলত, মা টক দৈ আছে?
হ্যাঁ ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার মধ্যে কিছু রহস্যময় ব্যাপার আছে। সুযোগ-সুবিধা মতো তিনি দু একটা কথা হয়ত তাকে জিজ্ঞেস করবেন। তবে ছেলেটা এমন কোন অপরাধ করেনি যে উকিল হয়ে প্রশ্ন করে তাকে নাজেহাল করতে হবে।
বাবার নাম কি?
মায়ের নাম কি?
দেশের বাড়ি কোথায়?
মামার বাড়ি কোথায়?
কোন জেলা, কোন গ্রাম?
পড়াশোনা কী?
যত ফালতু ব্যাপার। একটা দরিদ্র ছেলে বিপদে পড়ে কয়েক দিন আছে। যথাসময়ে চলে যাবে। নিজে থেকে যদি না যায় তিনিই চলে যেতে বলবেন। খুব ভদ্রভাবে বলবেন। যাতে বেচারা মনে কষ্ট না পায়। তিনি নিজে দরিদ্র মানুষ তাঁর পক্ষে যত দিন সম্ভব হয়েছে তিনি সাহায্য করেছেন। এখন আর পারছেন না।
মবিন উদ্দিন খুব ভাল করে জানেন সুরমা বা সুপ্তি কেউই ম্যাজিশিয়ান ছেলেটিকে চলে যেতে বলতে পারবে না। তারা ছেলেটাকে অসম্ভব পছন্দ করে। তার কাছে মনে হয় এটাও ঠিক না। কোন কিছুর বাড়াবাড়িই ভাল না। কাউকে পছন্দ করা ভাল, কিন্তু সেই পছন্দ বাড়াবাড়ি পর্যায়ের হওয়াটা ভাল না। তাঁর ধারণ সুরমা ও সুরমার কন্যা স্বাভাবিকভাবে কিছু করতে পারে না। সবকিছুকেই তারা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে যায়। ছেলেটাকে তিনি পছন্দ করেন তবে সেই পছন্দের মধ্যে কিন্তু আছে। বেশ বড় ধরনের কিন্তু। তার ধারণা ছেলেটা মনের কথা বুঝতে পারে। এরকম মনে করার পেছনে কারণ আছে।
গত পরশু দুপুরে তিনি খাওয়া দাওয়া করে শুয়েছেন। শীতকালের দুপুরে লেপের ভেতর ঢুকলে ঘুম আসবেই। তাঁরও ঘুম আসছে চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন, হঠাৎ মনে হল জর্দা দিয়ে একটা পান খেতে পারলো ভাল হত। ঘরে পানের চল নেই। পান যেতে হলে কাউকে দোকানে পাঠাতে হয়। বাবলু আছে, তাকে বলতেই হয়, বলতে ইচ্ছা করল না। সুরমা নানান ভেজাল করবে। হেন তেন শতেক প্রশ্নে মাথা ধরিয়ে দেবে।
পান আনাচ্ছ কেন?
জর্দা দিয়ে পান আবার কবে ধরলে?
একটা কোন নেশা ছাড়া থাকতে পার না না?
সিগারেট, পান, বাকি রইল কী? মদটা ধরে ফেল, তাহলে কেউ আর বলতে পারবে না যে একটা নেশা বাকি আছে।
শত প্রশ্নের জবাব দেবার চেয়ে শুয়ে থাকা ভাল। সন্ধ্যাবেলায় যখন বের হবেন তখন দোকান থেকে একটা পান কিনে নিলেই হবে। মবিন উদ্দিন ঘুমোবার আয়োজন করলেন, কিন্তু ঘুম এল না, মাথার মধ্যে পান ঘুরতে লাগল।
কয়েক বছর আগে ঢাকা শহরে স্টেডিয়ামে বরফ দিয়ে ঠাণ্ডা করা পান খেয়েছিলেন, সেই স্থানের দ্বাদ এখন মুখে লেগে রয়েছে। তিনি ঠিক করলেন, বইয়ের চালান আনতে এবার যখন ঢাকা যাবেন গোটা দশেক পান নিয়ে আসবেন। দোকানে রেখে দেবেন যে ক’দিন খাওয়া যায় খাবেন।
মনের এই অবস্থায় সুপ্তি ঢুকল। তাঁকে হতভম্ব করে দিয়ে বলল, বাবা এই নাও তোমার জর্দা পান।
তিনি বললেন, জর্দা পান মানে? পান কী জন্যে?
খাবার জন্যে আবার কী জন্যে।
কে এনেছে?
ম্যাজিশিয়ান ভাইয়া এনেছে।
সে শুধু শুধু পান আনবে কেন? তাকি কি মাই পান আনতে বলেছি?
বলেছ নিশ্চয়ই ভুলে গেছ। ইস বাবা তুমি সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত কথা যে বলতে পার। আশ্চর্য। কথা বাড়িও না পান নাও আমি হোম ওয়ার্ক করছি।