- বইয়ের নামঃ কালো যাদুকর
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প, উপন্যাস, কল্পকাহিনী
পৌষের শুরু
কালো যাদুকর
ভূমিকা
আমি যা বিশ্বাস করি তাই লিখি। অবিশ্বাস থেকে কিছু লিখতে পারি না। আমার বিশ্বাসের জগৎটা আবার খুবই বিচিত্র। সেই বিচিত্র বিশ্বাসের একটা গল্প লিখলাম। গল্পটিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ না করাই ভাল হবে।
হুমায়ূন আহমেদ।
৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮
ধানমণ্ডি, ঢাকা।
০১.
পৌষের শুরু।
জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। সবাই বলাবলি করছে গত বিশ বছরে এমন শীত পড়েনি। এ বছর বুড়ো মরা শীত পড়েছে, এই শীতে দেশের সব বুড়োবুড়ি মরে যাবে।
প্রতি শীতেই এ-জাতীয় কথা লোকজন বলে। তবে এবারের কথাটা বোধ হয় সত্যি। নেত্রকোনা বিউটি বুক সেন্টারের মালিক মবিন উদ্দিনের তাই ধারণা।
মবিন উদ্দিনের গায়ে ফুল-হাতা সোয়েটার। লাল রঙের মাফলারে মাথা কান সব ঢাকা। তারপরেও “বাড়তি সাবধানতা” হিসেবে ট্রাঙ্ক থেকে পুরানো একটা শাল বের করে তিনি গায়ে দিয়েছেন। শাল থেকে ন্যাপথলিনের বিকট গন্ধ আসছে। গন্ধ আগে টের পাওয়া যায়নি, রাস্তায় নেমে টের পেলেন। তাঁর গা গুলাতে লাগলো। তার গন্ধ বিষয়ক সমস্যা আছে। কড়া কোন গন্ধই সহ্য হয় না। শুরুতে গা গুলাতে থাকে, তারপর মাথা ধরে, বমি বমি ভাব হয়। একবার কী মনে করে কাঁঠাল চাপা ফুলের গন্ধ শুকেছিলেন। গন্ধটা সাঁই করে মাথার ভিতর ঢুকে গেল। তারপর কী যে অবস্থা। তিনি বমি করতে শুরু করলেন। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আটবার বমি করে চোখ-টোখ উল্টে বিছানায় পড়ে গেলেন। ডাক্তার আনতে হলো, স্যালাইন দিতে হলো। হুলুস্থুল ব্যাপার।
শাল থেকে এত কড়া ন্যাপথলিনের গন্ধ আসবে জানলে তিনি ভুলেও শাল গায়ে দিতেন না। বড় বড় ভুল মানুষ জেনেশুনে করে না, নিজের অজান্তে করে। গন্ধওয়ালা শাল গায়ে দেয়া তার জন্যে বড় ধরনের ভুল। শুরুতে ভুলটা ধরা পরে। নি, কারণ তাঁর নাক ঢাকা ছিল মাফলারে। নাকে গন্ধ যেতে পারছিল না। রাস্তায় নেমে বড় গাঙ্গের বাঁধের উপর নতুন রাস্তায় ওঠার পর নাক থেকে মাফলার সরে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে সই করে ন্যাপথলিনের গন্ধ তার নাকের ভেতর দিয়ে একেবারে মগজে ঢুকে গেলো। তিনি কী করবেন ভেবে বের করতে পারলেন না। অর্ধেকের বেশি পথ চলে এসেছেন। আবার বাসায় ফিরে যাওয়ার কোনো অর্থ হয়। শালটা খুলে রাস্তায় ফেলে দেয়া যায় না। তিনি দরিদ্র মানুষ। তার অল্প কিছু দামী জিনিসপত্রের একটা হচ্ছে এইখাদ্য। উনিশ বছর আগে বিয়েতের এক মামাশ্বশুর দিয়েছিলেন। উনিশ বছরেও শালটার কিছু হয়নি। পৌষের এই প্রচণ্ড শীতে শাল গায়ে দেয়ার জন্যেই মোটামুটি গরম লাগছে। শুধু গন্ধটা কষ্ট দিচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করা শুরু হয়েছে। গা এখনো গুলাতেও করেনি। তবে শুরু করবে। কে জানে রাস্তার পাশে বসেই হয়তো বমি করতে হবে। এটা নিশ্চয়ই কোন রোগ। তবে হাস্যকর হলেও এই রোগের চিকিত্সা হওয়া উচিত। রোগটা সারা জীবন তাঁকে কষ্ট দিয়েছে।
মবিন উদ্দিন দ্রুত হাঁটছেন। সূক্ষ্ম চেষ্টা চালাচ্ছেন গন্ধকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে। লাভ হচ্ছে না, গন্ধ সঙ্গে সঙ্গে আসছে। নাক বন্ধ করে তিনি এখন মুখে শ্বাস নিচ্ছেন। কাজটা ভুল হচ্ছে, এতে বুকে দ্রুত ঠাণ্ডা লেগে যায়। তিনি যাচ্ছেন নেত্রকোনা রেল স্টেশনের উত্তরে বৈদ্যহাঁটা–তাঁর ছোট বোনা রাহেলার বাসায়। রাহেলার বড় মেয়ে মিতুর বিয়ের কথা হচ্ছে। পাত্র পক্ষের কয়েকজন আসবে। চা-টা খাবে, পাকা কথা হবে। তার উপস্থিত থাকা অত্যন্ত জরুরি। জুরুরি না হলে তিনি বেরুতেন না। কয়েকদিন ধরে তার শরীর ভাল যাচ্ছে না। রোজ সন্ধ্যার দিকে গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। মনে হয় ম্যালেরিয়া। লোকজন যে বলছে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া চলে গেছে এটা ঠিক না। কিছুই পুরোপুরি চলে যায় না, কিছু ফিরে ফিরে আসে। ম্যালেরিয়া আবার ফিরে এসেছে, এবং তাঁকে শক্ত করে ধরেছে।
মুবিন উদ্দিন বাঁধের রাস্তা ছেড়ে মাছ-পট্টি দিয়ে বাজারে ঢুকে গেলেন। বাজার থেকে রিকশা নেবেন। তাঁর হাঁটতে ভাল লাগছে না, ভাল লাগলে হাঁটতে হাঁটতেই যেতেন। কিছু একসারসাইজ হত। তাঁর বয়স পঞ্চাশের মতো এই বয়সে হাঁটা-হাঁটির মতো একসারসাইজ অত্যন্ত জরুরি। হাঁটা-হাঁটি একেবারেই হচ্ছে না। সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বইয়ের দোকানে বসে বসে শরীর ধসে গেছে। তাও যদি বিক্রিবাটা হত একটা কথা ছিল, কোন বিক্রি নেই। বইয়ের দোকান না দিয়ে একটা ভিডিও ক্যাসেটের দোকান দিলে হত। রমরমা ব্যবসা একেক সময় একে জিনিসের সিজন আসে, এখুন ভিডিও ক্যাসেটের সিজন।
রাত আটটার মতো বাজে। প্রচণ্ড শীতের কারণেই বোধ হয় বাজারের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ। নিধু সাহার কাপড়ের দোকানটা খোলা। ক্যাশ বাক্সের সামনে নিধু সাহা বিরস মুখে বসে আছে। বিক্রি বাটা মনে হয় ভাল না। মাছ-পট্টির সামনে চায়ের স্টলটা খোলা। সেখানে হিন্দি গান হচ্ছে—“মেরা বাচপান চলা গিয়া।” কয়েকজন কাস্টমার বসে বসে বিরক্ত মুখে চা খাচ্ছে। হিন্দি গান তাদের বিরক্তি দূর করতে পারছে না।
চায়ের স্টলে হিন্দি গান ছাড়া অন্য গান বাজানো হয় না কেন ভাবতে ভাবতে রিকশার খোঁজে মবিন উদ্দিন এদিক ওদিক তাকালেন। কোন রিকশা নেই। চারদিক পুরোপুরি ফাঁকা। এই শীতে কোন রিকশাওয়ালাই বোধ হয় রিকশা বের করেনি। সবাই কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছে।