এক শ্রাবণ মাসের দুপুরে শলারাম বাথরুমে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বাড়িতে কেউ ছিল না। তার স্ত্রী সীতা গাউছিয়াতে সবুজ কাচের চুড়ি কিনতে গিয়েছিল। তার সব রঙের চুড়ি আছে কিন্তু সবুজ রঙের চুড়ি নাই। গাউছিয়ার এক চুড়ির দোকানে সে সবুজ চুড়ির অর্ডার দিয়ে রেখেছিল। দোকানদার বলেছে, আপা মঙ্গলবারে এসে নিয়ে যাবেন। আজ মঙ্গলবার।
আঠারটা সবুজ চুড়ি কিনে সীতা বাড়ি ফিরে দেখল স্বামী মৃত। এইসব ক্ষেত্রে স্ত্রীরা হাউমাউ করে কাঁদে। সীতা কাঁদল না। কারণ তার কান্না শোনার মতো ঘরে কেউ নাই। মেয়েরা একা একা কাঁদতে পারে না। সে তার আত্মীয়স্বজনদের খবর দিল। আত্মীয়স্বজন আসা, শুরু হওয়ার পরপর গলা ছেড়ে কাঁদতে বসল।
ডেডবডি রাতেই শ্মশানে দাহ করা হবে। মুখাগ্নি করবে শলারামের ছেলে প্রণব।
প্রণব ক্লাস সিক্সে পড়ে। সে গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জ তার জেঠির বাড়িতে। তাকে গাড়ি পাঠিয়ে আনা হলো। তাকে বলা হলো না যে তার বাবা মারা গেছেন। প্রণব ঘরে ঢুকেই বলল, বাবা!
শলারাম বলল, কী?
তোমার চোখ বন্ধ কেন?
শলারাম বলল, আমি মারা গেছি এই জন্যে চোখ বন্ধ।
প্রণব বাবার চোখের পাতা খুলে বলল, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?
শলারাম বলল, পাচ্ছি। ছায়া ছায়াভাবে দেখছি। মনে হচ্ছে সব ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট।
চিন্তার এই পর্যায়ে মুনিয়া দরজা ধরে দাঁড়াল এবং মিষ্টি গলায় বলল, স্যার কিছু লাগবে? রুস্তম মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে খানিকটা হকচকিয়ে গেল। মুনিয়া কালো রঙের গাউনের মতো একটা রাতপোশাক পরেছে। পোশাক পলিথিনের মতো স্বচ্ছ। মুনিয়ার নাভির ডান দিকের লাল তিলটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
রুস্তম চট করে চোখ ফিরিয়ে নিল। অস্বস্তির কারণে সে মুনিয়ার নাম ভুলে গেল। সে বিড়বিড় করে বলল, ময়ূরী। কিছু লাগবে না।
স্যার আমার নাম মুনিয়া।
ও আচ্ছা মুনিয়া। সরি নামটা ভুলে গেছি।
আমাকে ময়ূরী ডাকতে যদি আপনার ভালো লাগে তাহলে ময়ূরী ডাকবেন। আমার কোনো সমস্যা নেই।
আচ্ছা।
বিছানার চাদরটা কি পাল্টে দিব?
না না চাদর পাল্টাতে হবে না।
আপনার কাছে একটা কমপ্লেইন আছে। বলব?
বলো।
আপনার সামনে বসে বলি?
সামনে আসতে হবে না, যেখানে আছ সেখান থেকে বলো।
আপনার যে আর্টের টিচার, উনি আমাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছেন। বলেছেন, এক ঘণ্টা করে নেংটো হয়ে তার সামনে বসে থাকতে। তিনি ছবি আঁকবেন। ঘণ্টায় পাঁচশ টাকা দিবেন।
রুস্তম বলল, এটা কোনো কুপ্রস্তাব না। আর্টিস্টরা ছবি আঁকার জন্য মডেল ব্যবহার করে।
মুনিয়া বলল, আপনি যদি মডেল হতে বলতেন সেটা ভিন্ন কথা। চিনি জানি না তার সামনে নেংটো হয়ে বসে থাকব?
তাকে না করে দাও।
জি আচ্ছা। স্যার আমি কি চলে যাব?
হ্যাঁ। গুড নাইট।
চা-কফি কিছু খাবেন?
না।
স্যার আপনি কি কোনো কারণে আমার ওপর নারাজ?
নারাজ হবো কেন?
আমার মধ্যে কোনো দোষ-ত্রুটি দেখলে নিজের মুখে বলবেন। আমি শোধরাব।
আচ্ছা।
আর এখন থেকে আপনি আমাকে ময়ূরী নামে ডাকবেন। অন্য কোনো নামে ডাকলে আমি রাগ করব। সবাই ডাকরে মুনিয়া শুধু আপনি ডাকবেন ময়ূরী।
এখন যাও তো।
ধমক দিচ্ছেন কেন স্যার? মিষ্টি করে বলুন, ময়ূরী এখন যাও।
রুস্তম হতাশ গলায় বলল, ময়ূরী এখন যাও!
স্যার, আমি আমার ঘরের দরজা সবসময় খোলা রাখি। কোনো কিছুর দরকার হলে চলে আসবেন। দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকবেন স্যার। আমার শোয়া খুব খারাপ। কাপড়-চোপড় ঠিক থাকে না। এই জন্যে বললাম।
বলে ভালো করেছ। মুনিয়া এখন যাও। আমি জরুরি একটা কাজ করছি।
মুনিয়া বলবেন না স্যার। আমি ময়ূরী।
ময়ূরী এখন যাও। প্লিজ।
মুনিয়ার ওপর খানিকটা মেজাজ খারাপ করে রুস্তম ঘুমুতে গেল। মেজাজ খারাপের একমাত্র কারণ উপন্যাসের শুরুটা সে এলোমলো করে দিয়েছে। আবার নতুন করে মাথায় গোছাতে হবে। নতুন করে শুরু করা একদিক দিয়ে ভালো। কিছু কারেকশন করা হবে। বাথরুমে একা মরে পড়ে থাকাটা ভালো লাগছে না। মৃত্যু অনেকের সামনে হওয়া ভালো। ছুটির দিনে বাসার সবাই আছে। প্রণব তার বাবাকে গল্প শোনাচ্ছে, এই সময় হঠাৎ মাথা এলিয়ে শলারাম পড়ে গেল। শলারাম নামটাও এখন পছন্দ হচ্ছে না। প্রণব এবং সীতার সঙ্গে শলারাম যাচ্ছে না। এমন কোনো নাম খুঁজে বের করতে হবে যার অর্থ মৃত্যু। তার নাম প্রণাশ রাখা যেতে পারে। প্রণাশ শব্দের অর্থও মৃত্যু, বিনাশ। প্রণাশ চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে প্রণব চট্টোপাধ্যায়। স্ত্রীর নাম সীতা।
বালিশের কাছে রাখা টেলিফোন বাজছে। রুস্তম টেলিফোন ধরে বলল, হ্যালো।
ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠ বলল, তোর খবর কী?
রুস্তম টেলিফোনে গলা চিনতে পারে না। টেলিফোনে তার কাছে সব মেয়ের গলা একরকম মনে হয় আবার সব ছেলের গলা একরকম মনে হয়। রুস্তম বলল, কে?
আরে গাধা, আমি তোর বুবু।
বুবু কেমন আছ?
ভালো। তুই কি ঘুমিয়ে পড়েছিলি?
প্রায়।
মাত্র এগারোটা বাজে এর মধ্যেই ঘুম? শরীর ভালো তো?
হুঁ।
তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গে আমার বিষয়ে কোনো কথা হয়েছে?
না।
আমি চলে যাওয়াতে সে কী পরিমাণ আপসেটঃ
বুঝতে পারছি না। তবে আফতাব চৌধুরীর উপর দুলাভাই মনে হয় রাগ করেছেন। আমাকে বলেছেন ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে খুন করাবেন।
সিরিয়াসলি বলেছে?
হুঁ।
ওর পক্ষে অসম্ভব কিছু না।
বুবু আমি রাখি। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
ইন্টারেস্টিং একটা কথা বলে টেলিফোন রাখ। হুট করে টেলিফোন রেখে দেওয়া ঠিক না।