কে বলেছে?
আমার আর্ট টিচার। উনি প্রায়ই জিভ বের করে বসে থাকেন। মুখ থেকে জিভ বের করলে আমাদের মধ্যে কুকুর ভাব চলে আসে তখন রাগ পড়ে যায়।
আমিন বিরক্ত গলায় বললেন, উদ্ভট কর্মকাণ্ড তোমার আর্ট টিচার করুক। আমি করব না।
রুস্তম বলল, একটা এক্সপেরিমেন্ট করায় তো দোষ নাই। মুখ থেকে কিছুক্ষণের জন্যে জিভ বের করা।
আমিন জিভ বের করলেন। অদ্ভুত কাণ্ড। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর রাগ কমে গেল।
দুলাভাই! রাগ কমেছে?
হুঁ।
রুস্তম বলল, আমাকে খুব শিগগিরই একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। কবে নিয়ে যাবেন?
নতুন কোনো সমস্যা?
রুস্তম বলল, আমার কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে সামান্য সমস্যা হচ্ছে। প্রচ্ছদে ছিল সাইকেলের চাকায় একটা পাখি বসে আছে। কয়েক দিন হলো দেখছি পাখিটা চায়ের কাপের উপর বসে আছে।
বলো কি?
কবিতার বইটা আপনার কাছে আছে, নিয়ে আসুন না।
আমিন চিন্তিত মুখে কবিতার বইয়ের সন্ধানে গেলেন।
বই পাওয়া গেল। পাখিটা সাইকেলের চাকার উপরেই আছে। চা খেতে নিচে নামেনি। রুস্তম বই হাতে নিয়ে বলল, দুলাভাই দেখনু চায়ের কাপে বসে আছে।
আমিন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। রুস্তমের মাথা দ্রুত এলোমেলো হচ্ছে। আটকানোর বুদ্ধি কি কে জানে। তার ধারণা রুস্তমের ডাক্তার অবস্থাটা আরো খারাপ করে দিচ্ছে।
রুস্তম বলল, দুলাভাই এটা কি পাখি?
আমিন বললেন, জানি না। আমি পাখি চিনি না। ঢাকা শহরে যারা বাস করে তারা কাক ছাড়া আর কিছু চিনে না।
রুস্তম বলল, আমার ধারণা এটা ডাহুক পাখি। ডাহুক পাখি মারা গেলে কি করে জানেন?
না।
পা দুটা আকাশের দিকে তুলে রাখে।
কেন?
মৃত্যুর আগে আগে ডাহুক পাখি মনে করে আকাশ ভেঙে তার উপর পড়ছে। তখন সে দু পায়ে আকাশ আটকাতে চায়।
আমিন বললেন, এইসব কি তুমি নিজে নিজে বানাচ্ছ?
রুস্তম হাসল। তার হাসি সুন্দর। দেখতে ভালো লাগে।
দুলাভাই।
বলো।
আমার বইটার প্রচ্ছদ যে এঁকেছে তার সঙ্গে একটু দেখা করা দরকার।
কেন?
তাকে জিজ্ঞাস করতাম উনি কি পাখি এঁকেছেন।
এর কি দরকার আছে?
অবশ্যই দরকার আছে।
বাংলাবাজার চলে যাও। বই হাতে নিয়ে যাও। প্রেসের ঠিকানা দেয়া আছে। তুমি পান খেতে চেয়েছিলে। পান খুঁজে পেলাম না। দোকান থেকে একটা পান কিনে নিও।
জি আচ্ছা।
রুস্তমের কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ যিনি করেছেন তিনি বিরাট মাওলানা। চাপদাড়ি, চোখে সুরমা। বাংলাদেশের মাওলানারা মাথায় পাগড়ি কমই পরেন। ইনার মাথায় সবুজ রঙের পাগড়ি। মাওলানার নাম হাজি আসমত উল্লাহ।
রুস্তম বলল, মওলানা সাহেব এটা কি পাখি?
হাজি আসমত উল্লাহ বললেন, মনের ধ্যান থেকে এঁকেছি জনাব। কি পাখি বলতে পারব না। তবে পাখি আঁকা ঠিক হয় নাই। গুনাহর কাজ হয়েছে?
কেন?
পশু পাখি মানুষ আঁকা নিষিদ্ধ। এদের জীবন দেয়া যায় না বলেই নিষিদ্ধ। আমি একটা পাপ কাজ করে ফেলে গুনাগার হয়েছি।
আপনার আঁকা ছবি খুব সুন্দর হয়েছে। আমি একটা উপন্যাস লিখব বলে ঠিক করেছি। সেটার প্রচ্ছদও আপনি করবেন।
আল্লাহপাকের হুকুম হলে আমাকে করতেই হবে। উনার হুকুমের বাইরে যাওয়ার আমার উপায় নাই।
সবকিছুতেই তাঁর হুকুম লাগবে?
জি জনাব। এই যে আপনি নিঃশ্বাস নিচ্ছেন ফেলছেন তাও উনার হুকুমে চলছে। মনে করেন আপনি নিঃশ্বাস নিলেন তখনই আল্লাহপাক নিঃশ্বাস ফেলার হুকুম বন্ধ করলেন, আপনি আর নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন না। জনাব চা খাবেন?
খাব।
একটু বসেন। আমি জোহরের নামাজ আদায় করে নিজের হাতে আপনাকে চা বানায়ে দেব। আল্লাহপাকের হুকুমে আমি খুব ভালো চা বানাতে পারি।
গোলাম মওলা এসেছেন রুস্তমের কাছে
গোলাম মওলা এসেছেন রুস্তমের কাছে। গোলাম মওলা রুস্তমের প্রাক্তন শ্বশুর। তাঁর কন্যা দিনার সঙ্গে রুস্তমের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ে তিন বছর টিকেছিল।
গোলাম মওলা সাদা লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি পরেছেন। গায়ে তসরের চাদর। কিছুদিন আগেও তার গালভর্তি দাড়ি ছিল, এখন নেই। মাথার চুলে মেন্দি দিয়েছেন। চুল টকটকে লাল। গোলাম মওলা জর্দা দিয়ে পান চিবুচ্ছেন বলে ঘরময় জর্দার গন্ধ। গন্ধটা কড়া না মিষ্টি। তিনি বসেছেন দোতলার বারান্দায়। তার কোলের কাছে বাঁকানো বেতের লাঠি। রুস্তম লাঠিটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে, উনি লাঠিটা মেঝেতে ছেড়ে দিলেই এটা একটা সাপ হয়ে যাবে। রুস্তমের খানিকটা ভয় ভয়ও লাগছে।
রুস্তম ভালো আছ?
জি।
প্রায়ই তোমার কথা মনে হয়। আসা হয় না। আজ ঠিক করে রেখেছি। যত কাজই থাকুক তোমার এখানে একবার আসব।
লাঠিটা কোত্থেকে কিনেছেন?
ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে কিনেছি। দিনা কিনে দিয়েছে। লাঠিটা কি তোমার পছন্দ হচ্ছে?
জি।
রেখে দাও।
রুস্তম আগ্রহ করে লাঠি নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। খাটের সঙ্গে লাঠি দাঁড়া করিয়ে ফিরে এলো।
গোলাম মওলা বললেন, তোমার চিকিৎসা ঠিকমতো চলছে তো?
জি চলছে।
চিকিৎসায় অবহেলা করবে না। রোজ খানিকক্ষণ হাঁটবে। যে কোনো রোগের জন্য হাঁটা এবং ঘুমানো হলো মহৌষধ। আমি এই বয়সেও ঘড়ি ধরে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটি। ডাক্তার আধঘণ্টা হাঁটতে বলেছিলেন, আমি পনের মিনিট বেশি হাঁটি।
রুস্তম বলল, অধিকন্ত ন দোষায়।
কী বললে?
বললাম, অধিকন্তু ন দোষায়, অর্থাৎ বেশিতে দোষ হয় না।
এটা কোন ভাষা?
সংস্কৃত।
তুমি সংস্কৃত জানো নাকি?
জি না। কিছু শ্লোক জানি।