হোসেন মিয়া আধঘণ্টা সময় নিয়ে গোসল করল। গরম চায়ের সঙ্গে সিগারেট খেল। একটা সিগারেটের অর্ধেক শেষ হয়েছে, এর মধ্যেই অন্য আরেকটা সিগারেট বের করে দেয়াশলাইয়ের পাশে রেখে দিয়েছে।
সে বসেছে রুস্তমের ঘরে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুস্তমের আঁকা ছবির দিকে।
এই ছবি আপনি এঁকেছেন?
জি।
চোখের পাপড়ি কোবাল্ট রু দিয়ে এঁকেছেন?
জি।
চোখের মণিতে লেমন ইয়েলো দিয়েছেন কেন?
চোখ কোমল করার জন্য।
মেয়েটা কি ফিরে এসেছে?
না।
মন থেকে এঁকেছেন?
জি।
ছবিটা যে অসাধারণ হয়েছে, এটা বুঝতে পারছেন?
না।
এমন ছবি একটা এঁকে মরে গেলে কোনো ক্ষতি নেই। ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কী মনে হচ্ছিল জানেন? মনে হচ্ছিল, যে কোনো মুহূর্তে মেয়েটা কথা বলে উঠবে। ছবি আঁকা নিয়ে আপনাকে অনেক কঠিন কঠিন কথা বলেছি। ফালতু উপদেশ দিয়েছি। আপনি ক্ষমা করবেন।
রুস্তম বলল, আপনার ভালো খবরটা কি এখন বলব?
হোসেন মিয়া ছবি থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, বলুন।
ফ্রান্স দূতাবাস থেকে চিঠি এসেছে। ফ্রান্স সরকার আপনাকে একটা স্কলারশিপ দিয়েছে। এক বছরের স্কলারশিপ। সব ফ্রি। হাতখরচ হিসেবে সপ্তাহে পঞ্চাশ ইউরো করে পাবেন।
এত বড় খবরেও হোসেন মিয়ার ভাবান্তর হলো না। সে ছবির দিকেই তাকিয়ে রইল।
হোসেন মিয়া বলল, মুনিয়া মেয়েটাকে এই ছবিটি দেখানো দরকার।
মুনিয়া তো রোজই দেখে।
তার মানে?
মানে আপনি বুঝবেন না। এটা আমার মনের একটা রোগ।
হোসেন মিয়া বিড়বিড় করে বললেন, ভাই যে হাতে আপনি ছবিটা এঁকেছেন, সেই হাতটা দিন। আমি আপনার হাতে চুমু না খাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাব না।
বছর ঘুরে নতুন বছর এসেছে। সামিনা দুই কন্যা ডাবল স্ট্রলারে শুইয়ে বড় শপিংমলগুলোতে যাচ্ছে। সামিনার সঙ্গী আমিন। বাচ্চা দুটিকে এক মুহূর্ত না দেখে সে থাকতে পারে না। সে এখন কোনো ব্যবসা দেখে না। মুখে বলে, সব গোল্লায় যাক। মেয়ে দুটা ঠিক থাকলেই আমি ঠিক। দুটা ফুটফুটে মেয়ে পাশাপাশি শুয়ে আছে, এই দৃশ্য অনেকেই অবাক হয়ে দেখে। মুগ্ধ চোখে বলে, কী সুন্দর! কী সুন্দর!
আমিনের খুবই চিন্তা হয়। নজর লাগবে না তো! সে স্ত্রীর কানে কানে তার দুশ্চিন্তার কথা জানায়। সামিনা বলে, দুজনকেই কালো মোজা পরিয়ে রেখেছি। নজর লাগবে না।
হোসেন মিয়া চলে গেছে ফ্রান্সে। সেখানে সে ভালোই আছে। অবসর সময়ে অপূর্ব সব ওয়াটার কালার করছে। বিষয়বস্তু বাংলার গ্রাম। তার অনেক ছবিতে শান্ত দিঘির জলের পাশে একটি তরুণীকে বসে থাকতে দেখা যায়। তরুণীর চেহারার সঙ্গে মুনিয়ার সাদৃশ্য আছে।
বিভাস দার্জিলিংয়ে পড়তে গেছে। যাওয়ার সময় বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে হঠাৎ বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে খুব কাঁদল। রুস্তম বলল, কাঁদছ কেন বাবা? বিশ্বাস করো সারাক্ষণ তুমি আমার পাশেই থাকবে। আমার খুব ভালো একটা অসুখ হয়েছে। এই অসুখের কারণে আমি আমার পছন্দের যে কোনো মানুষকে আমার পাশে বসিয়ে রাখতে পারি।
বাবা তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
আমি নিজেও বুঝতে পারি না। নিজের কাছেও মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগে। মনে করো তুমি দার্জিলিংয়ে পড়ছ। হঠাৎ আমার ইচ্ছা হলো তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি। ইচ্ছাটা হওয়া মাত্র তোমাকে আমি আমার সামনে দেখব। তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারব।
কম্পিউটার দিয়ে? আমার মা আমাকে একটা ল্যাপটপ দিয়েছে। ল্যাপটপের সামনে বসে আমি যখন মার সঙ্গে কথা বলব তখন মা তার কম্পিউটারে আমাকে দেখতে পাবে।
রুস্তম বলল, অনেকটা সে রকমই, শুধু কম্পিউটার নেই।
বিভাস বলল, মনে হয় তোমার মাথার ভেতর আছে। আমাদের সায়েন্স মিস বলেছেন মানুষের ব্রেইন খুব পাওয়ারফুল কম্পিউটার।
হতে পারে।
মানুষের ব্রেইনে অনেক মেগাবাইট মেমোরি। মেগাবাইট কি তুমি জানো?
না।
তুমি সায়েন্সে দুর্বল তাই না?
হ্যাঁ।
চাঁদ যে একটা আয়না এটা জানো?
না।
আমাদের সায়েন্স মিস বলেছেন চাঁদ একটা আয়না। এই আয়নায় সূর্যের আলো পড়ে। আয়না সেই আলো পৃথিবীতে পাঠায়।
তোমাদের সায়েন্স মিস তো অনেক গুছিয়ে কথা বলেন।
আমাদের সায়েন্স মিসের নাম মিস রুমা। তুমি যে ছবিটা আঁকছ মিস রুমা সেই ছবির মতো সুন্দর। তোমাকে একটা গোপন কথা বলব বাবা?
বলো।
কাউকে কিন্তু বলতে পারবে না।
কাউকে বলব না।
আমি বড় হয়ে সায়েন্স মিসকে বিয়ে করব।
আমি কি সেই উৎসবে থাকতে পারব? দাওয়াতের কার্ড কি পাঠাবে?
বিভাস হালকা গলায় বলল, মা তোমাকে কার্ড পাঠাতে দেবে না। তুমি তো পাগল এই জন্যে। পাগলদের কোনো অনুষ্ঠানে ডাকতে হয় না। পাগলরা ঝামেলা করতে পারে।
তাও ঠিক।
আমার গত জন্মদিনে এই জন্যে মা তোমাকে দাওয়াত করেনি। মা ভালো করেছে না?
হ্যাঁ।
মিস রুমা জন্মদিনে এসেছিলেন। তিনি আমাকে একটা অটোগ্রাফের বই দিয়েছেন। বইটা আমি নিয়ে এসেছি। বাবা তুমি আমার অটোগ্রাফ বইতে কিছু লিখে দাও।
রুস্তম লিখল,
দিঘির কালো জলে
আনন্দে ভেসে চলে
অলৌকিক এক চন্দ্রহাঁস
আমাদের ছোট্ট বিভাস॥
ডাক্তার রেণুবালা বিদেশি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন। রুস্তমের চিকিৎসা বন্ধ। রেণুবালা প্রায়ই নিউজার্সি থেকে রুস্তমকে টেলিফোন করেন। তার উপন্যাস কেমন এগোচ্ছে জানতে চান। তিনি রুস্তমকে একটা বইও পাঠিয়েছেন, Brain and Mind।
মাসে একবার তিনি টেলিফোনে দীর্ঘ সময় ধরে রুস্তমের সঙ্গে কথা বলেন। টেলিফোনে তার গলা কিশোরীদের গলার মতো শোনায়। তার কথা শুনতে রুস্তমের খুব ভালো লাগে।