ছগীর বলল, স্যার আমি পুলাপান না। কেন আমারে বুঝ দেন? তালেব কই আছে বললে সেও মরব আমিও মরব। এরচে আমার একা মরা ভালো না।
মেজর ইসমাইল চোখে সানগ্লাস পরলেন। সন্ধ্যার পর মেজর সাহেবের চোখে সানগ্লাস পরা খারাপ লক্ষণ।
ছগীর! রাতের খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
না।
কি খেতে চাস বল, বিরানি?
জে। সাথে একটা লাচ্ছি দিয়েন। স্যার আরেকটা কথা, দুই বোতল পাগলের তেল আমি একজনের জন্যে কিনেছি। তার ঠিকানা দিতেছি তেলের বোতল দুটা তার হাতে পৌছায়ে দিবেন। যদি পৌছায়া না দেন রোজ হাশরে আমি আপনার ঘাড় কামড়ায়া ধরব। রোজ হাশরে আপনার হাতে বন্দুক থাকব না কিন্তু আমার মুখে দাঁত ঠিকই থাকব।
পরদিনের খবরের কাগজে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বিরানি ছগীরের ক্রস ফায়ারে মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হলো।
রুস্তম খবরের কাগজ পড়ে না কাজেই ছগীরের মৃত্যু সংবাদ সে জানল। দুপুরবেলা অচেনা এক লোক তাকে দু বোতল পাগলের তেল দিয়ে গেল।
আমিনের তাড়া খেয়ে রুস্তমের বাড়ি ছেড়ে যারা পালিয়ে গিয়েছিল একে একে তারা সবাই ফিরে আসছে। সবার আগে উপস্থিত হলেন চণ্ডিবাবু। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠার ক্ষমতা তার নেই। ড্রাইভারের কাঁধে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে দোতলায় উঠলেন। রুস্তমের শোবার ঘরে উঁকি দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, স্যার আমার অন্তিম সময় উপস্থিত। শেষ কয়েকটা দিন কি আপনার বাড়িতে থাকতে পারি?
রুস্তম বলল, অবশ্যই পারেন।
চণ্ডিবাবু বললেন, স্যার আপনার জন্যে আমার কিছু করতে ইচ্ছে করে। কি করব বুঝতে পারি না। আমার শক্তি নাই, সামর্থ্য নাই। জ্ঞান-বুদ্ধিও নাই।
আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে পনার শরীর খুবই খারাপ। কি হয়েছে বলুন তো।
হাঁপানি আগেই ছিল এখন বেড়েছে। আর কিছু না।
হাসপাতালে ভর্তি করে দেই? কিছু দিন হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন।
আমি হাসপাতালে যাব না। আপনার আশেপাশেই থাকব। বেশ তো থাকুন।
চণ্ডিবাবুর দাখিল হবার পরদিনই ফিটবাবুকে দেখা গেল। তার সবকিছুই আগের মতোই আছে, শুধু টাইয়ের রঙ বদল হয়েছে। এখন টাইয়ের রঙ সবুজ।
রুস্তম সাইকেল নিয়ে বের হচ্ছে তখন ফিটবাবুর সঙ্গে দেখা। সে ছুটে এসে গেট খুলতে খুলতে বলল, স্যারের কিছু লাগবে?
কিছু লাগবে না।
স্যার কি ভালো আছেন?
হ্যাঁ ভালো।
স্যার আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টি নামবে। আজ সাইকেল নিয়ে বের না হলে ভালো হয়।
রুস্তম বলল, কোনো অসুবিধা নেই। না হয় কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজব।
স্যার আমি কি একটা ছাতা নিয়ে পিছনে পিছনে আসব?
না। আপনি ফিরে এসেছেন এটা দেখে ভালো লাগছে। যারা চলে যায় তারা কখনো ফিরে আসে না।
স্যার আমাকে তুমি করে বলবেন।
আচ্ছা বলব।
রুস্তম সাইকেল নিয়ে বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টি নামল। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট অদ্ভুত। আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখা গেলেই রাস্তায় পানি উঠে যায়। বৃষ্টি পড়ার প্রয়োজন হয় না।
মাথায় বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় পানি। রুস্তম পানি কেটে এগুচ্ছে। তার চমৎকার লাগছে। প্রণাশ বাবুর মৃত্যুর ব্যাপারটা নতুন করে মাথায় এসেছে। ঝড়-বৃষ্টির রাতে তার মৃত্যু হলে কেমন হয়? পথের পাঁচালি উপন্যাসে দুর্গার মৃত্যু যেমন হলো। রুস্তম প্রণাশ বাবুর মৃত্যুর বিষয়টা মাথায় সাজাতে সাজাতে এগুচ্ছে।
প্রণাশ বাবুর মৃত্যু
(ঝড়-বৃষ্টির রাত)
সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি। শোঁ শোঁ বাতাস। মিউনিসিপালটি ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে শহর অন্ধকার করে দিয়েছে।
প্রণাশ বাবু বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ঘরে ফিরলেন। স্ত্রীকে বললেন, গরম পানি করো তো। ড্রেনে পড়ে গিয়েছিলাম, পা কেটেছে। একটা টিটেনাস ইনজেকশন নেয়া দরকার।
প্রণাশ বাবুর স্ত্রী বললেন, কি সর্বনাশ! রক্তে তো তোমার পাজামা ভিজে গেছে। এতটা কাটল কিভাবে?
কথা বলে সময় নষ্ট করো না। তাড়াতাড়ি পানি গরম করো…।
চণ্ডিবাবুর ফেরার দুদিন পর বৃহস্পতিবার দুপুরে আর্টিস্ট ফিরে এলো। মনে হয় সে বিরাট কোনো ঝামেলার ভেতর দিয়ে গিয়েছে। চোখ-মুখ শুকনা। গায়ের কাপড় নোংরা। পায়ে জুতা নেই। হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বাম চোখের চারপাশে কালো ছোপ। চোখ লাল হয়ে আছে। চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে। রুস্তম বলল, আপনার এই অবস্থা কেন?
দুই রাত হাজতে ছিলাম। পুলিশ মারধর করেছে।
হাজতে ছিলেন কেন?
পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে এই জন্য ছিলাম। ইচ্ছা করে কেউ হাজতে যায়? হাজত তো হোটেল না।
পুলিশ ধরল কেন?
এত প্রশ্নের জবাব তত দিতে পারব না। এখন গরম পানি দিয়ে স্নান করব, তারপর আগুনগরম এক কাপ চা বাব। সাত দিন গোসল করি নাই।
দুদিন ছিলেন হাজতে, সাত দিন গোসল করেননি কেন?
আপনার কাছে কৈফিয়ত দেব কী জন্য? আপনি কি অ্যাটর্নি জেনারেল? সিগারেট আনিয়ে দিন। দুই দিনে সিগারেটে একটা টানও দিতে পারি নাই। টাকা নাই যে কাউকে দিয়ে সিগারেট আনা।
রুস্তম বলল, সিগারেট আনিয়ে দিচ্ছি। আপনার একটা ভালো খবর আছে।
ভালো খবরের আমি গুষ্টি কিলাই। আগে গোসল, তারপর গরম চা-সিগারেট। তারপর ভাত খেয়ে ঘুম। আপনার বদ দুলাভাইটা শুনেছি বাড়িতে নাই।
ঠিকই শুনেছেন। উনি মালয়েশিয়ায়।
থাক ব্যাটা মালয়েশিয়াতে। আর আসবি না। তোকে বাংলাদেশের প্রয়োজন নাই। আমি একজন আর্টিস্ট মানুষ। আমাকে সিঁড়িতে ধাক্কা দিয়েছে। একটু হলে পা পিছলে পড়তাম।