আমি ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ি বের করে একে যশোরের নাইটকোচে তুলে দিয়ে আসো।
মেয়ের সে কী ফড়ফড়ানি। বলে কী, স্যার আমি কিন্তু চলন্ত ট্রাকের সামনে ঝাঁপ দিয়ে পড়ব।
আমি বললাম, চলন্ত ট্রাক, চলন্ত বাস, চলন্ত বেবিট্যাক্সি যার সামানে পড়তে ইচ্ছা করে পড়বি। আমার কোনো সমস্যা নাই।
রুস্তম বলল, মুনিয়া চলে গেছে?
আমিন বললেন, ড্রাইভার যশোরের টিকিট কেটে তাকে নাইটকোচে তুলে দিয়ে এসেছে। বদ মেয়েছেলে!
রুস্তম বলল, দুলাভাই আপনি সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার শরীর কাঁপছে। যে কোনো মুহূর্তে পড়ে যাবেন। আপনি রাগটা কমান। জিভ বের করে কিছুক্ষণ ফ্যানের নিচে বসুন।
আমিন বললেন, তুমি আমার ঘরে আসো। তোমার বুবু আমাকে এখন একটা sms পাঠিয়েছে। এর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার ধারণা, তোমার বুবুও তোমার পথ ধরেছে। ব্রেইন গন উইথ দ্য উইন্ড।
আমিনের sms-এ লেখা–
The baby is now about 12.5 cm or 4.92 inches. He/she is now producing urine and actually urinating into the amniotic fluid. At this week your baby is regular wiggler but because of his/her small size you probably wont feel it.
আমিন বললেন, এর মনে কী?
রুস্তম বলল, এর মানে বুবুর বাচ্চা হবে। বাচ্চাটা সম্পর্কে কথাবার্তা লেখা।
বলো কী?
আপনার উচিত এক্ষুনি বুবুর কাছে যাওয়া।
এক্ষুনি যাব কিভাবে? ভিসার ব্যাপার আছে না? ও আচ্ছা আচ্ছা, ভিসা তো করানো আছে। তোমার বুবুর ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিষ্ঠ হয়ে দুজন মালয়েশিয়ার ভিসা করিয়েছিলাম। সে বলেছে, আমাকে খুব ভালো একটা খবর বিদেশে গিয়ে দেবে। ব্যবসার একটা ঝামেলায় পড়ে বললাম, এই বছর যাওয়া সম্ভব না। সে আরেকজনকে নিয়ে চলে গেল। এখন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলছে। টেলিফোনে ঘেউ ঘেউ কেন করছে, এটা বুঝতে পারছি opti
আপনাকে বিরক্ত করছে আর কিছু না।
আফতাব হারামজাদাটা তো মনে হয় এখনো ঝুলে আছে।
ঝুলে থাকতে পারে, তবে দুলাভাই আপনি নিশ্চিত থাকেন বুবু তাকে কাছে ঘেঁষতে দেবে না।
আমিন বললেন, এখন তুমি সামনে থেকে যাও। আমি ঠাণ্ডা মাথায় কিছুক্ষণ চিন্তা করি। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। আর্টিস্টের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। সে নিজের ঘরে বসে কী খাচ্ছে, না খাচ্ছে এটা তার ব্যাপার। আমাকে দ্রতা করে খেতে বলেছে। এটা অন্যায় কিছু না, বরং এটাই শোভন। মুনিয়া মেয়েটাকেও জোর করে নাইট কোচে তুলে দেওয়া অন্যায় হয়েছে। আমার মাথায় রাখা উচিত ছিল, সে একটা মেয়েমানুষ। I am such a fool.
বৃষ্টি বেড়েছে। জানালার পর্দা উড়ছে। বৃষ্টির ছাট আসছে। রুস্তম লেখার টেবিলে মোমবাতি এবং দেয়াশলাই নিয়ে বসেছে। ঢাকা শহরে রাতে বৃষ্টি নামলেই ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। রুস্তমের লেখালেখি করতে ইচ্ছে করছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন তাকে সবসময় আনন্দে থাকতে হবে। আনন্দের অনুসন্ধান করতে হবে। তার মধ্যে এ মুহূর্তে আনন্দের ঘাটতি আছে। আর্টিস্ট চলে গেছে তাতে রুস্তমের তেমন খারাপ লাগছে না। হোসেন মিয়া কখন থাকত, কখন থাকত না তা বোঝা যেত না।
মুনিয়া চলে গেছে সেটাও খারাপ লাগছে না। এটা মুনিয়ার বাড়ি না। একসময় তাকে চলে যেতেই হবে। খারাপ লাগছে মেয়েটা সত্যি সত্যি যদি ট্রাকের নিচে পড়ে! এই সম্ভাবনা আছে। ডাক্তার বলেছেন।
রুস্তম কারেন্ট চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আজকের লেখালেখি হবে মোমবাতির আলোয়। প্রণাশের মৃত্যুর আরেকটা ভার্সন লেখা হবে। এই ভার্সানে প্রণাশ মারা যাবে চলন্ত ট্রাকের নিচে পড়ে। সে তার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বের হয়েছিল। চিড়িয়াখানায় যাবে, জীবজন্তু দেখবে। রিকশার সন্ধানে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল। রাস্তার ওপাশে একটা রিকশা দেখা গেল। এই রিকশা, যাবে বলে প্রণাশ এগিয়ে যেতেই একটা ট্রাক তাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে গেল।
স্যার, ঘুমাবেন না?
রুস্তম চমকে তাকাল। মুনিয়া আগের মতোই তার বিছানার পাশে পাটি পেতে শুয়ে আছে। তার গায়ের শাড়িও আগের মতোই এলোমেলো।
তুমি যশোর যাওনি?
মুনিয়া উঠে বসে মাথার চুল বাঁধা শুরু করল। জবাব দিল না।
আমি ভেবেছিলাম তুমি চলে গেছ। এখন তমাকে দেখে খুবই ভালো লাগছে।
মুনিয়া বলল, আজ সারাদিন আপনার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে। শুয়ে পড়েন।
প্রণাশ বাবুর মৃত্যুর অংশটা লিখে শুয়ে পড়ব। আমি ঠিক করেছি উনি মারা যাবেন ট্রাকে চাপা পড়ে।
মুনিয়া শুতে শুতে বলল, আহা বেচারা!
রুস্তম বলল, শাড়ি ঠিকঠাক করে ঘুমাও।
মুনিয়া শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল, সরি।
রুস্তম বলল, তুমি ঠোঁটে কালো লিপস্টিক দিও না। কালো লিপস্টিকে তোমাকে কুৎসিত লাগে।
মুনিয়া বলল, আর দেব না স্যার।
রুস্তম অবাক হয়ে দেখল, মুনিয়ার ঠোঁটে কালো লিপস্টিক নেই। তার ঠোঁটে এখন হালকা গোলাপি আভা। রুস্তম দরজার দিকে তাকাল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। এর একটাই অর্থ, মুনিয়া নেই। সে মুনিয়াকে কল্পনা করছে। সে সাধারণ মানুষ না। একজন অসুস্থ মানুষ বলেই কল্পনাটাকে বাস্তব মনে হচ্ছে।
মুনিয়া!
মুনিয়া পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, আমাকে মুনিয়া ডাকবেন না। আমাকে ডাকবেন ময়ূরী।
ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। রুস্তম মোমবাতি জ্বালিয়ে খাতা খুলল। তার কাছে খুবই ভালো লাগছে যে, মুনিয়া কাছেই শুয়ে আছে।
ময়ূরী।
জি স্যার।