আপনার বলতে ইচ্ছা করছে অবশ্যই বলবেন।
দুলাভাইয়ের স্ত্রী, অর্থাৎ আমার বুবু দুলাভাইকে ছেড়ে তার বন্ধুর সঙ্গে মালয়েশিয়া চলে গেছে। দুলাভাইয়ের গায়ের ঘামের গন্ধ পছন্দ না বলে বুবু চলে গেছেন।
এটা তো strange কোনো ঘটনা না। এটা দুঃখজনক ঘটনা। দুঃখজনক ঘটনা, আনন্দজনক ঘটনা, অদ্ভুত ঘটনা, এর মধ্যে আপনাকেই পার্থক্য করতে হবে।
রুস্তম বলল, আমার বুবুর অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো সে দিন-রাত দশ থেকে বারোবার দুলাভাইকে টেলিফোন করে। দুলাভাই টেলিফোন ধরলেই বুবু বলেন, ঘেউ ঘেউ।
কী বলেন?
কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ শব্দ করেন।
Oh God.
রুস্তম বলল, আমি এ ঘটনার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। আমার ব্যাখ্যাটা শুনবেন?
শুনব।
বুবু দুলাভাইকে অত্যন্ত পছন্দ করেন বলেই বারবার টেলিফোন করেন। ঘেউ ঘেউ শব্দ করে দুলাভাইকে বিরক্ত করার জন্য। দুলাভাই যদি মালয়েশিয়া উপস্থিত হন তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আপনার যুক্তি আমি গ্রহণ করছি। ভালো যুক্তি দিয়েছেন।
রুস্তম বলল, আমি যে আনন্দজনক ঘটনা, দুঃখের ঘটনা কিংবা অদ্ভুত ঘটনা আলাদা করতে পারি না, তাও ঠিক না। আমার জীবনে আজ একটা দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে। বলব?
অবশ্যই বলবেন।
আমার একটা ছেলে আছে, তার নাম না। সে ক্লাস ফোরে পড়ে। স্কুল থেকে তাকে তার বাবার ওপর এক শ শব্দের একটা রচনা লিখতে দেওয়া হলো। সে দুলাইনেই রচনা শেষ করেছে। সে লিখেছে—
My father is a mad person.
I dont know anything about him.
আপনার একটা ছেলে আছে, এটাই তো জানতাম না। আপনি বলেননি কেন?
আপনি আমাকে বলেছেন সবসময় আনন্দে থাকতে–এই জন্য ছেলের কথা মনে করি না। কাউকে বলিও না।
আমি আপনার ডাক্তার। আমাকে সবকিছু বলতে হবে। আপনার স্ত্রীর কথা বলুন।
ওর নাম দিনা। একসময় আমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লাম, তখন সে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে ছেলে নিয়ে চলে গেল। ভালোই করেছে। দিনা খুব বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে। তার ছেলেটার বুদ্ধি মায়ের মতো হয়েছে কি না কে জানে!
রু আদে সাহেব চা খাবেন?
না। আমি চা খাই না।
খান না তাতে কী? আজ চা খাবেন। আপনাকে সামাজিক হতে হবে। একসঙ্গে চা খাওয়া একটা Social event. আসুন দুজন মিলে চা খেতে খেতে কিছুক্ষণ গল্প করি।
আচ্ছা।
আপনি কি দস্তয়েভস্কির ইডিয়ট উপন্যাসটা পড়েছেন?
না।
ওই উপন্যাসে প্রিন্স মিশকিন নামে একটি চরিত্র আছে। চরিত্রটার সঙ্গে আপনার মিল আছে। প্রিন্স মিশকিন ছিলেন একজন শুদ্ধতম মানুষ। তিনিও আপনার মতো অসুস্থ ছিলেন। উপন্যাসটা দেব? পড়বেন?
না, উপন্যাস পড়তে আমার ভালো লাগে না।
উপন্যাস পড়তে আপনার ভালো লাগে না, অথচ আপনি নিজেই উপন্যাস লিখছেন? ব্যাপারটা কন্ট্রাডিক্টারি না?
জি।
তাতে সমস্যা কিছু নাই। মানুষ মানেই কন্ট্রাডিকশন।
রুস্তম বলল, আপনাকে একটা জরুরি কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। ভুলে গেছি বলে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। এখন মনে পড়েছে।
চা আসুক। চায়ে চুমুক দিতে দিতে জরুরি কথাটা বলবেন।
চা আসতে আসতে ভুলে যেতে পারি। এখনই বলি?
বলুন।
আমার বাড়িতে মুনিয়া বলে একটা মেয়ে থাকে। রাগ করলেই সে বলে, আমি ঝাপ দিয়ে চলন্ত ট্রাকের সামনে পড়ে যাব। চলন্ত ট্রাকের নিচে ঝাপিয়ে পড়া তার পক্ষে কি সম্ভব?
রেণুবালা বললেন, বারবার যদি বলে, তাহলে সম্ভব। একটা কথা বারবার বললে Inhibition কেটে যায়। যারা আত্মহত্যা করে, তারা কিন্তু বারবার মৃত্যুর কথা বলে। এক সময় মৃত্যুবিষয়ক Inhibition কেটে যায়।
তখন ফ্যানে শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ে, কিংবা ঘুমের ওষুধ খায়।
চা চলে এসেছে। রুস্তম আগ্রহ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। রেণুবালা বলল, আপনি কি গান শোনেন?
না।
মাঝে মধ্যে গান শুনবেন। মোঞ্জার্টের মিউজিক আপনার ভালো লাগবে বলে আমার ধারণা। মোঞ্জার্ট মানসিক রোগী ছিলেন। প্রায়ই তিনি অদ্ভুত সব জিনিস দেখতেন, বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই।
বৃষ্টি হচ্ছিল। রিকশার হুড তুলেও বৃষ্টি পুরোপুরি আটকানো গেল না। রুস্তম বাড়ি ফিরল কাকভেজা হয়ে। বাড়িতে নানান ঝামেলা। হৈচৈ হচ্ছে, চিৎকার হচ্ছে। আমিন দাঁড়িয়ে আছেন দোতলার সিঁড়ির কাছে। রাগে তার শরীর কাঁপছে। রুস্তম বলল, কী হয়েছে?
আমিন বললেন, আর্টিস্টের বাচ্চাকে গলাধাক্কা দিয়ে বিদায় করেছি। যেতে চায় না। বলে কী, বৃষ্টির মধ্যে কিভাবে যাবে?
আমি বললাম, ভিজতে ভিজতে যাবি।
তারপরেও তর্ক করে। বলে কী আমার টনসিলের ধাত। বৃষ্টিতে ভিজলে টনসিল পেকে যাবে।
আমি বললাম, তখন পাকা টনসিল নিয়ে ঘুরবি।
রুস্তম বলল, দুলাভাই আপনি শান্ত হন। আপনাকে খুবই অস্থির লাগছে। আপনার হাত-পা কাঁপছে। সবাইকে তুই তুই করে বলছেন এটাও তো ঠিক না।
আমিন বললেন, আমি সন্ধ্যাবেলায় আর্টিস্টের ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। গাঁজার বিকট গন্ধে থমকে দাঁড়ালাম। আমি বললাম, কী খাচ্ছেন?
আর্টিস্টের বাচ্চা বলল, গাঁজা খাচ্ছি আর বোতল খাচ্ছি। স্যার আমার সঙ্গে বোতল খাবেন? কত বড় দুঃসাহস চিন্তা করেছ? ওই বদ মেয়েটাকেও বিদায় করেছি।
কার কথা বলছেন, মুনিয়া?
হা। উল্টাপাল্টা কথা চারদিকে বলে বেড়াচ্ছে। রাতে নাকি তোমার সঙ্গে ঘুমায়। ইচ্ছা করছিল চড় দিয়ে চাপার কয়েকটা দাঁত ফেলে দেই। মেয়ে মানুষ বলে সেটা সম্ভব হয়নি। আমি বললাম, এই তোর দেশের বাড়ি কোথায়?
সে বলল, যশোর।